
হিন্দি তথা বলিউড সিনেমা হল ভারতীয় সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শুক্রবার, অর্থাৎ ছবি মুক্তির দিনগুলোতে, রূপালি পর্দায় পছন্দের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখবার জন্যে, লাখো মানুষের ভিড় উপচে পড়ে দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোয়। বলিউড তারকারা অনুরাগীদের মধ্যে দেব-জ্ঞানে পূজিত হন, ইন্ডাস্ট্রির চাকচিক্যে আকর্ষিত হয়ে বহু মানুষ আবার মুম্বাইতে কাজ করতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এইভাবে প্রতিদিন আরব সাগরের তীরে, মায়ানগরীর বুকে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিচিত্র, ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের মেলবন্ধনে সেই ইন্ডাস্ট্রি পরিপূর্ণতা পায়।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে, বোম্বাইয়ের (বর্তমান মুম্বাই) চলচ্চিত্র দেশগঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল। তখনো এর নামকরণ ‘বলিউড’ হয়নি। চিত্রনাট্য কিংবা গান লেখা হত মূলত হিন্দুস্তানি ভাষায় ও উর্দু হরফে। প্রত্যেক ছবিতে থাকত দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু ইতিবাচক বার্তা। সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা দেশটি যখন সবে গুটি-গুটি পায়ে সার্বিক উন্নয়নের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে, তখন বিমল মিত্র, রাজ কাপুর, শান্তারাম, খাজা আহমেদ আব্বাস, চেতন আনন্দ, গুরু দত্তদের মতো চিত্র-পরিচালকদের সিনেমা দর্শকদের মনে এনে দিয়েছিল প্রগতিশীলতা, সামাজিক সংহতি ও সহাবস্থানের ভাবনা, যা দেশগঠনের ক্ষেত্রে তৎকালীন রাষ্ট্রনায়কদের উন্নয়নশীল চিন্তারই প্রতিফলন ছিল। এইভাবে, কালক্রমে জাতিগত ঐক্য ও সামাজিক সম্প্রীতির আরেক নাম হয়ে উঠেছিল ‘বলিউড’।
কিন্তু সাম্প্রতিককালে, বিজেপি শাসনের আমলে দেখা যাচ্ছে, বলিউড সিনেমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক পেশীশক্তির আস্ফালনের একটি অস্ত্র হিসাবে। খুব সুচতুরভাবে প্রযোজক ও চিত্র-পরিচালকেরা বেছে নিচ্ছেন কিছু বিতর্কিত ঐতিহাসিক চরিত্রদেরকে, যাদের মাধ্যমে চরিতার্থ করা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী-ফ্যাসিবাদী ভাবনাকে। এতে, বলিউড ইন্ডাস্ট্রির রাজনীতিকরণ ও গেরুয়া-শিবিরের প্রতি তোষামোদের বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে। মিলিটারি ও যুদ্ধ-বিষয়ক ছবি, কিংবা সন্ত্রাসবাদ-দমন বিষয়ক ছবি এমনভাবে বানানো হচ্ছে, যেখানে বেছে বেছে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা দেশকেই দায়ী করে দেখানো হচ্ছে। ইতিহাস আর তথ্যকে সুকৌশলে ও ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা হচ্ছে, দেখানো হচ্ছে একতরফা আখ্যান, ছড়ানো হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ, জাগিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষের ভাবনাকে। দেশপ্রেমের নামে বক্সঅফিসে বিক্রি হচ্ছে উগ্র-জাতীয়তাবাদের টিকিট, বিঘ্নিত হচ্ছে বহু শতক ধরে গড়ে তোলা মানুষ-মানুষের সম্প্রীতি।
এইভাবে, ক্ষমতায় আশার পর থেকেই গেরুয়া-শিবির, দেশের শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে মিডিয়া পর্যন্ত সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে কব্জা করে মানুষের ভাবনাচিন্তা ও জনজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। বলিউডের গেরুয়াকরণও সেই কর্মকাণ্ডেরই অংশ বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।