Monday, June 9, 2025
30 C
Kolkata

সদ্যসমাপ্ত  বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ের পশ্চাতে দায় কার ?

বিশেষ প্রতিবেদন, এনবিটিভিঃ  ৫ রাজ্যের ভোট ও তার ফলাফল সমাপ্ত হয়েছে। পাঞ্জাব ছাড়া বাকি রাজ্যে (উত্তর প্রদেশ, গোয়া,উত্তরাখণ্ড, মনিপুর) বিজেপি জয় পেয়েছে । তবে বড় রাজ্য বলতে একমাত্র উত্তর প্রদেশ। পাঞ্জাবে কংগ্রেসকে ধরাশায়ী করে নতুন দল হিসেবে এবারই প্রথম সরকার গঠন করবে আপ। সেখানে বিজেপি প্রায় মুছে গিয়েছে। কংগ্রেস ৫রাজ্যেই ধরাশায়ী । তার পরেই পরাজিতের বড় তালিকায় বিএসপি ও মিম।

  উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের ফলাফলের দিকে এবার নজর ছিল সব চাইতে বেশি। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ জয় পেয়ে উগ্র হিন্দুত্বের পোস্টার বয় যোগী আদিত্য নাথ পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। তবে, যতটা ঢাকঢোল পিটিয়ে জয় প্রচার করা হচ্ছে ততটা জয় বিজেপির হয়নি। মূলতঃ বিরোধীদের অনৈক্যের উপর ভর করেই বিজেপির এই জয় হাসিল হয়েছে।

     বিরোধীদের অনৈক্য সত্ত্বেও বিজেপির এই জয় প্রত্যাশিত মনে হয়নি অনেকের কাছেই। তার অনেক যুক্তিও রয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষের কাছে হিন্দুত্বের সুড়সুড়ি ছাড়া বিজেপির শাসনে (কেন্দ্র-রাজ্য উভয়ই) দেশের মানুষের মৌলিক-অমৌলিক কোন প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে এমনটা কেউ বলতে পারবে  না । দেশে নিত্যপ্রয়োজন বলে নয়, সমস্ত জিনিস পত্রের দামই হুহু করে বেড়েছে। বেকারত্বের হার অনেক আগেই রেকর্ড করে বিপদসীমা ছাপিয়ে গেছে। অর্থনীতির হাল বেশ করুণ। নোটবন্দীর স্বপ্ন ভুল তা অনেক খেসারত দিয়ে বুঝতে হয়েছে। শিল্প-জিডিপি নিম্নগামী।

একের পর এক বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সরকারি সম্পত্তি। ডলারের তুলনায় টাকার মূল্য টেক্কা দিবে বলা হয়েছিল, অথচ তার অস্বাভাবিক পতন ঘটে চলেছে। পরিষেবা এখন চড়া দামে কিনতে হচ্ছে, তা ব্যাঙ্ক, এটিএম, রেল, যাই হোক।ব্যাঙ্ক লুটও অতীতের রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ চোঁ-চোঁ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী নির্যাতন, দুর্নীতি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মুসলিম-দলিত-আদিবাসী নির্যাতন সমান তালে চলছে। হাথরাস, উন্নাও-এর বর্বরতার কথা কি সহজে ভুলে যাওয়ার? এর পরেও রয়েছে কৃষি আন্দোলন।

এই সমস্ত কারণগুলিকে সামনে রাখলে ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের জয় প্রত্যাশিত মোটেও বলা যায় না। —এত্থেকেই প্রশ্নটা আরো গভীর হয়ে ওঠে, এতকিছুর পরেও শুধু মাত্র ধর্মীয় সুড়সুড়িতেই, বা ৮০-২০-র ঘৃণা-বিদ্বেষের তাস খেলেই  বিজেপি উতরে গেল? ভারতের মানুষ কি এতটাই ধর্মদুষ্ট ? বিশ্বাস হয় না। তাহলে ?

       তাহলে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়? হ্যা। মমতা ব্যানার্জি সহ অনেকে ইভিএম কারচুপির কথা বলেছেন। কিন্তু তার স্পষ্ট চিত্র পাওয়া মুশকিল। ইভিএমে যতদিন ভোট হবে ততদিন এই অস্বস্তি কাটবে বলে মনে হয় না। এবারের নির্বাচনে ইভিএমের ভূমিকা যাই হোক, বর্ণ বাদীদের বহু পুরাতন অস্ত্র ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল’ পলিসি এবং ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ এই দুটি কারণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে অন্ততঃ ইউপি-র গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে বলে মনে হয়। এবারের নির্বাচনে বিজেপির বাঁচার একমাত্র রাস্তাটি ছিল বিরোধীদের অনৈক্য–যা থেকে বিরোধীরা বেরিয়ে আসতে পারে নি। ফলে ভোট ভাগ হয়ে বিজেপির জয় চওড়া হতে পেরেছে। এক্ষেত্রে দুই সুপ্রিমো–বহুজন সমাজ পার্টির মায়াবতী এবং মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলেমিনের আসাদউদ্দিন ওয়াইসিকে অনেকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন।

       এবারে মায়াবতীর ভূমিকা যে নেতিবাচক ছিল তা অনেক আগেই বোঝা গিয়েছে। তিনি আগেই টের পান–এবারে কোনভাবেই তাঁর ভাগ্যে ক্ষমতার শিকে ছিঁড়বে না। তাই আগে থেকেই তিনি  ঠিক করে নেন নিজের নাক কেটে অখিলেশের যাত্রা ভঙ্গ করবেন। অখিলেশকে ধরাশায়ী করে বিজেপিকে জয়ী করলে তিনি পরবর্তীতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন এই তাঁর ভাবনা। এটি মায়াবতীর বড় দুর্বলতা নি:সন্দেহে । মায়াবতী যে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছেন তার জন্য প্রথমতঃ তিনি নিজেই  দায়ী। এখন রাজনীতিতে মায়াবতীর পরিচয় নীতিহীন নেত্রী হিসেবে।

দলিত মূলনিবাসী সমাজের নেত্রী হয়েও মায়াবতী এর আগেও মূলনিবাসী দলিত সমাজের প্রধান শত্রু বিবেচিত বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তাদের অক্সিজেন জুগিয়েছেন । দলে ব্রাহ্মণদেরও স্থান দিয়েছেন। এসবই কাঁসিরামজীর বিরোধী নীতি। অথচ তিনি কাঁসিরামজীর সাধনার ফলই ভোগ করছেন বলা যায়। এবারের নির্বাচনে তাঁর ভূমিকা যেন অনেকটাই বিভীষণের মত, সেই মত তিনি  বিজেপিকে সুবিধা করে দিতে পরিকল্পনা নিয়ে ফেলেন। যার ফলে তাঁকে নির্বাচনের লড়াইয়ে তেমনভাবে লক্ষ্য করা যায় নি, অথচ তিনি প্রার্থী দাঁড় করাতে কোন কার্পণ্যও করেন নি।

এখন কেউ যদি অভিযোগ করে–প্রার্থীদের টাকা বিজেপিই দিয়েছে তবে এই অভযোগকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এই অভিযোগও ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না তিনি মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করাতে  দরাজহস্ত হয়েছেন যাতে মুসলিম ভোট কেটে বিজেপির জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। তাঁর একটি মাত্র আসনে জয় এসব অভিযোগকেই প্রত্যয়িত করছে।

         ওয়াইসির ভূমিকাকেও বিশ্লেষকরা একই দোষে দুষ্ট দেখিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেখিয়েছেন, ১৬৫টি আসনে বিজেপি জয়ী হয়েছে মাত্র ২০০০ ভোটের ব্যবধানে। গোটা হিসেবটা এই রকম–বিজেপির ৭ আসনে জয় মাত্র ২০০ ভোটের ব্যবধানে, ২৩ আসনে জয় মাত্র ৫০০ ভোটের ব্যবধানে, ৪৯টি আসনে জয় ১০০০ ভোটের ব্যবধানে, ৮৬টি আসনে জয় ২০০০ ভোটের ব্যবধানে।এসবের সিংহভাগ আসনে বহুজন সমাজ ও মিম প্রার্থী দিয়েছে।

এই যদি হয়, সেখানে ওয়াইসিকে অবশ্যই দায় নিতে হবে। ফ্যাসিবাদী বিজেপি যেখানে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যার পরিণাম ভয়াবহ হবে–এটা জানার পরও ওয়াইসি যে প্রার্থী প্রদানে বেপরোয়া হয়েছেন তাকে ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপই বলতে হয়। বিহার নির্বাচন থেকেই তাঁকে শিক্ষা নেয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল। সেখানে তবু ৫টি আসন পান, ইউপিতে শূন্য হয়েছেন। এসডিপিআই দল কিন্তু এক্ষেত্রে যথেষ্ট সংযত থেকেছে। তারা এমন কোন ক্ষেত্রে প্রার্থী দেয়া থেকে বিরত থেকেছে যেখানে তাদের কারণে বিজেপি সুবিধা পেতে পারে।

এই পার্থক্যের কারণ–গনতন্ত্র বনাম সুপ্রিমো সিস্টেম, ওয়াইসি সুপ্রিমো হওয়ায় তাঁকে প্রশ্ন করা মুশকিল ; এসডিপিআই সেখানে গনতান্ত্রিক কাঠামো দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় প্রশ্ন করা, আলোচনা করার অবকাশ খোলামেলা এবং প্রসারিত।

         তবে, ওয়াইসির মিম, এসডিপিআই, ডব্লিউ পিআই প্রভৃতি দলগুলিকে যেভাবে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয় তাও সমালোচনার উর্ধ্বে বলা যায় না। প্রথমতঃ, মেইন স্ট্রিম পার্টিগুলি এইসব দলগুলিকে কোনরকম গুরুত্বই দিতে চায় না। বড় দলগুলি ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করার চাইতেও এদের দমন করাকে যেভাবে গুরুত্ব প্রদান করে তা রীতিমত ভাবনার বিষয়। কারণ গনতান্ত্রিক দেশে এই দলগুলি যাদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে চায় তার অবকাশ তাদের কেন দেয়া হবে না ?

কেন তাদের বাধ্য করা হবে অন্যদের অনুগ্রহপ্রার্থী হয়ে থাকতে ? ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করার দায় কি শুধু এদেরই ? তবে বড় দলগুলিকে ছাড় দিয়ে শুধু মাত্র এসব দলগুলিকেই কেন দায়ী করে আক্রমণ নানান হয়? এবারের নির্বাচনে অখিলেশ যাদব যদি এদেরকে গুরুত্ব দিতেন তবে বিজেপির জয় আটকানো যেত, তাতে তিনিও লাভবান হতেন।

বিহারের গত নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটতে পারতো। বারবার এমনটা ঘটার পরও তারা এব্যাপারে কোন গুরুত্ব যে দিচ্ছেন না তা কি কিছু কম দোষণীয় ? এই ভুল যে  এসপি-আরজেডিই করছে তা নয়, কংগ্রেস, টিএমসি, বামফ্রন্ট সকলেই করছে। এদের আচরণ এমনই যে, যেন ফ্যাসিবাদী শক্তির চাইতে মুসলিম, আদিবাসী প্রভৃতি মূল নিবাসীরাই দেশের জন্য বড় বিপদ। রাজনীতির  এই ভুল ছিদ্র পথ ধরেই কালনাগিনী বিজেপি ভারত আত্মাকে বারবার দংশন করার সুযোগ পাচ্ছে।

Hot this week

গাজার রাফাহ সহায়তা কেন্দ্রেই মৃত্যু: ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২৭ জন ফিলিস্তিনি

ফের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় রাফাহ শহরের একটি...

মাদ্রাসা রক্ষায় আজমগড়ে সম্মেলন, আদালতের পথে জামিয়ত উলামা-ই-হিন্দ

উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে আয়োজিত হয় একটি মাদ্রাসা রক্ষা সম্মেলন...

ঈদের আগে উত্তেজনা: গাজিয়াবাদে মুসলিম মাংস বিক্রেতাকে গুলি করার হুমকি বিজেপি বিধায়ক নন্দ কিশোর গুর্জর

উত্তরপ্রদেশর গাজিয়াবাদে বিজেপি বিধায়ক নন্দ কিশোর গুর্জর সম্প্রতি একটি...

টাকার পরিমান দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গেল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার, গ্রেপ্তার ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস অফিসার

চোখ ধাঁধানো গুপ্তধনের সন্ধান। ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস অফিসার অমিত...

Topics

গাজার রাফাহ সহায়তা কেন্দ্রেই মৃত্যু: ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২৭ জন ফিলিস্তিনি

ফের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় রাফাহ শহরের একটি...

মাদ্রাসা রক্ষায় আজমগড়ে সম্মেলন, আদালতের পথে জামিয়ত উলামা-ই-হিন্দ

উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে আয়োজিত হয় একটি মাদ্রাসা রক্ষা সম্মেলন...

গাজায় ফের ইসরায়েলি হামলা!ধ্বংস করা হল ২৪০টির বেশি ঘর, নিহত হাজার হাজার নিরীহ মানুষ

গত অক্টোবর থেকে ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ হামলা চালিয়ে আসছে।...

Related Articles

Popular Categories