কয়লার অভাব, লাগাতার বিদ্যুৎ সঙ্কটের সম্ভাবনা; সাবধান করলো কেন্দ্র সরকার

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

images (13)

সৌম্য মন্ডল

অক্টোবর মাস মানেই সারা দেশে উৎসবের শুরু, উৎসব মানেই লাগাম ছাড়া বিদ্যুৎ খরচ। তা ছাড়া সাধারণ ভাবে কারখানা চালানো হোক বা ফোন চার্জ বা ফ্যান চালানো, বিদ্যুৎ ছাড়া জীবনের কথা ভাবাই যায় না। কিন্তু অক্টোবরের শুরুতেই সাবধান করে দিলো ইউনিয়ন সরকার। দেশে ১৩৫ টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রিসিটি অথরিটি ( CEA) এর রিপোর্ট অনুসারে ২৫টা এমন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে যেখানে, ৩ অক্টোবরের হিসেব অনুযায়ী তাদের কাছে যে পরিমান কয়লা আছে, তা দিয়ে ৭ দিনের বেশী চলা সম্ভব নয়। ৬৪ টা এমন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে যাদের মজুত কয়লায় ৪ দিনের বেশী বিদ্যুৎ উৎপাদন চালানো যাবে না। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোর কাছে মোট কয়লা মজুত আছে ৭৮ লাখ টনের সামান্য বেশী। আর দেশের ১৩৫টা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে চলতে মোট কয়লার প্রয়োজন হয় ১৮ লাখ টনের মত। গত ৬ অক্টোবর বিদ্যুৎ মন্ত্রী আর কে সিং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন এরকম সঙ্কট আগে কখনো হয়নি। আগামী পাঁচ / ছয় মাস বিদ্যুৎ সমস্যা চলতে পারে।

পশ্চিম বঙ্গে এখনো বিদ্যুৎ সমস্যা দেখা না গেলেও ৮ অক্টোবর সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এর প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা নথিভুক্ত করা হয়েছে। সে খানে দেখা যাচ্ছে বিহারের মধুবনির এক ইলেকট্রনিক স্টোর ম্যানেজার প্রশান্ত রাজ জানিয়েছেন গত কয়েক দিন ধরে দিনে ৭/৮ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। রাজস্থান রাজ্যের রাজধানী জয়পুর থেকে ৫০ কিমি দূরে আলিসার গ্রামের ৫২ বছর বয়স্ক স্থাপত্যবিদ বৈশালী মাস্টার জানিয়েছেন গত ৪ দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ ছিলো না। রাতে বিদ্যুৎ থাকছে না বললেই চলে। কেরালার এক রাজ্য বিদুৎ বোর্ডের সিনিয়র আধিকারিক জানিয়েছে যে তারা নাগরিকদের বিদ্যুৎ কম খরচ করার উপদেশ দিয়েছেন। শিল্প বহুল রাজ্য গুজরাট এবং হরিয়ানায় এই সপ্তাহে ব্যাপক ভাবে বিদ্যুৎ এর ঘাটতি দেখা গেছে। উত্তর প্রদেশে ব্যাপক ভাবে বার বার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ফেডারেল গ্রিড রেগুলেটর POSOCOর তথ্য থেকে রয়টার্স দেখিয়েছে যে ঝাড়খণ্ড বিহার এবং রাজস্থান সবচেয়ে বেশী বিদ্যুৎ সঙ্কটে ভুগছে।

তবে এই বিদ্যুৎ সঙ্কট শুধুমাত্র ভারতে নয়। আন্তর্জাতিক স্তরেই কয়লার সঙ্কট শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে কয়লার দাম। বেশ কিছু দিন ধরে চীন বিদ্যুৎ খরচা কমাতে বাধ্য হয়েছে। প্রশাসনের তরফে রাত্রে রাস্তার ধারে আলো জ্বালানো বন্ধ হয় বিভিন্ন বিদ্যুৎ খরচার ক্ষেত্র বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বেজিং সহ চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।

২০২০ সালের ফোবস ম্যাগাজিন জানাচ্ছে দুনিয়ার প্রয়োজনীয় শক্তির ৮৪% আসে ফসিল জ্বালানি(খনিজ তেল, কয়লা) থেকে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি(IEA) এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দুনিয়ায় উৎপাদিত কয়লার মধ্যে চীন ৫৬%, ভারত ১১%, আমেরিকা ৬% ভোগ করে থাকে। কোনো দেশের উন্নতির অন্যতম মাপকাঠি হল বিদ্যুৎ খরচার পরিমাণ। ভারত আর চীনের জনসংখ্যা প্রায় সমান হলেও বিদ্যুৎ খরচা দেখিয়ে দেয় দুই দেশের অর্থনৈতিক পার্থক্য। অন্যদিকে আমেরিকার বিদ্যুৎ এর চাহিদা চীনের থেকে অনেক বেশী হলেও, তারা কয়লা বাদে অন্য উৎস গুলোর ব্যবহার ব্যাপক ভাবে বাড়িয়েছে। অন্যদিকে চীন এবং ভারত মূলত কয়লার উপর নির্ভর করে।গত ১৮ মাসে বিদ্যুৎ এর গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ কোটি। বিদ্যুৎ মন্ত্রক বা মিনিস্ট্রি অফ পাওয়ার এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে দেশে বিদ্যুৎ এর চাহিদা ছিলো ১০৬ বিলিয়ন ইউনিট। ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে দেশে বিদ্যুৎ এর চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৪ বিলিয়ন ইউনিট। একদিকে যেমন বিদ্যুৎ এর চাহিদা বেড়েছে, অন্যদিকে হয়েছে যোগানের ঘাটতি।

ভারতের বিদ্যুৎ চাহিদার ৭০% যোগান দেয় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলো। ৪ ভাগের ৩ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় দেশে উৎপাদিত কয়লা থেকে। বাকি একভাগ উৎপাদিত হয় বিদেশ থেকে আমদানি করা কয়লা থেকে। সাধারণত বর্ষা কালে খোলা মুখ খনি থেকে কয়লা উৎপাদন কম হয় এবং পরিবহনে সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু এই বারের পূর্ব এবং মধ্যে ভারতে অস্বাভাবিক অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং বন্যা উৎপাদন কে অনেক কমিয়ে দিয়েছে।

সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২১ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাস্টেলের কয়লার দাম বেড়েছে ২৫০%। ভারত প্রধানত ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করে থাকে। এই সময়কালে ইন্দোনেশিয়ার কয়লার দাম বেড়েছে ২৩৩%। ভারত প্রধানত আগের বছরের তুলনায় এই বছর কয়লা আমদানি কমেছে ৪৭%। বিদ্যুৎ এর দাম বাড়লে দেশের বেশীরভাগ মানুষ সেটা কিনতে পারবেনা। অন্যদিকে বর্তমান দামের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে তা উৎপাদন খরচে পোষাবে না। এই টানাপোড়েনে গুজরাটে টাটা এবং আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রদুটিতে ঝাঁপ পড়েছে। অন্যদিকে চীনের অর্থনীতিতে সরকারি পরিকল্পনার বিশেষ গুরুত্ব থাকায় যে বিদ্যুৎ সঙ্কট থেকে চীনের কারখানা গুলোকে বাঁচাতে যে কোনো ভাবে, অতিরিক্ত দাম দিয়েও বিভিন্ন দেশ থেকে চীন এখন কয়লা আমদানি করে সঙ্কট মোকাবিলার চেষ্টা করছে।

সাধারণ খনিতে কয়লা উত্তলনের পর যে কাউকে বিক্রি করা যায়। ক্যপটিভ খনি হল সেই সমস্ত খনি যা কোনো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকে। কয়লা সঙ্কট মোকাবিলায় এবার মোদি সরকার নতুন নিয়ম করেছে যে ক্যাপটিভ খনি গুলো নিজের ৫০% কয়লা খোলা বাজারে বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু এর ফলে অন্য আশঙ্কা থেকে যায় যে কয়লা উৎপাদন এবং খরচে ব্যাপক ভাবে সরকারি পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রনের বদলে বেসরকারি হাতে ছেড়ে দিলে আরো দ্রুত কয়লা ফুরিয়ে আসবে।

ECL কোলিয়ারি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শৈলেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্যের সাথে বর্তমান প্রতিবেদক যোগাযোগ করলে তিনি জানান- ” কয়লা একটি জাতীয় সম্পত্তি, অপচয় না করে পরিকল্পিত ভাবে কয়লা ব্যবহারের জন্য দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক সরকারের প্রয়োজন, এই সরকার পুজিঁপতিদের দালাল, মুনাফা ছাড়া কিছুই বোঝে না, ফলে অতিরিক্ত মুনাফার স্বার্থে অপরিকল্পিত অপচয়ই করবে, অদূর ভবিষ্যতে যখন আমার দেশে কয়লার সঞ্চয় শেষ হয়ে যাবে, তখন কী হবে, তার কথা কে ভাবছে?”

অন্যদিকে ছত্তিসগড়ের বিশিষ্ট সমাজকর্মী এবং উকিল সুদীপ শ্রীবাস্তব টুইটারে দাবি করেছেন কয়লার ঘাটতির গল্পটা সরকারের বানানো। সংসদে আগামী অধিবেশনে Coal Bearing Area (Acquisition and Development) Act 1957 সংশোধন করে কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করতে নতুন বিল আনার জন্য এই গল্পটা তৈরি করা হয়েছে। তার ব্যাখা ভারতের বিদ্যুৎ এর চাহিদা ১.৫ লাখ মেগাওয়াট। সৌর বিদ্যুৎ, জল বিদ্যুৎ, বায়ু শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা বিপুল আকারে বৃদ্ধির জন্য কয়লা থেকে ১ লাখ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ এলেই কাজ চলে যায়। এর জন্য প্রয়োজন ৫০০ মিলিয়ন টন কয়লা। কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড সেখানে একাই ৬০০ মিলিয়ন টন কয়লা উৎপাদন করেছে। নতুন আইন সংশোধনী বিল পাস করিয়ে বন এবং পরিবেশ আইনকে ধ্বংস করে কর্পোরেট এর স্বার্থ রক্ষা করতে কয়লা সঙ্কটের ভুয়ো গল্প রটানো হয়েছে।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর