যিলহজ মাসের ১ম দশ দিনের ফযিলত জানুন

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

IMG-20200714-WA0058

এনবিটিভি ডেস্ক: যিলহজ মাসের ১ম মাসের প্রথম দশদিন আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরকালের পুঁজি সঞ্চয় করার এক সূবর্ণ সুযোগ। এ দিনগুলো গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

-কসম ভোরবেলার। কসম দশ রাতের। [সূরা ফাজর, আয়াত: ১-২]
ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য যিলহজ মাসের দশ দিন।
.
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
-যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।[সূরা হজ, আয়াত: ২৮]
এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিনসমূহ বলতে কোনো দিনগুলোকে বুঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে ইমাম বুখারি রহ. বলেন,
-ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন: ‘নির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
-যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করার মত অধিক প্রিয় আল্লাহর নিকট আর কোনো আমল নেই। তারা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদ করাও কি তার চেয়ে প্রিয় নয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ﷺ বললেন: না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তির কথা আলাদা যে তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদে বের হয়ে গেল অতঃপর তার প্রাণ ও সম্পদের কিছুই ফিরে এলো না।[বুখারি: ৯৬৯, তিরমিযি: ৭৫৭]
.
ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহর নিকট কোনো দিন অধিক প্রিয় নয়, আর না তাতে আমল করা, এ দিনের তুলনায়। সুতরাং, তাতে তোমরা বেশি করে তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদ পাঠ কর।[তাবরানী ফীল মুজামিল কাবীর]
.
সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রাহি:) এর অভ্যাস ছিল, যিনি পূর্বে বর্ণিত ইবনে আব্বাসরে হাদিস বর্ণনা করেছেন: যখন যিলহজ মাসরে ১ম দশ দিন প্রবেশ করত, তখন তিনি খুব মুজাহাদা করতেন, যেন তার উপর তিনি শক্তি হারিয়ে ফেলবেন।[দারামী: ২৫৬৪ হাসান সনদে]
.
ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন: যিলহজ মাসের দশ দিনের ফযিলতের তাৎপর্যের ক্ষেত্রে যা স্পষ্ট, তা হচ্ছে এখানে মূল ইবাদতগুলোর সমন্বয় ঘটছে। অর্থাৎ সালাত, সিয়াম, সদকা ও হজ, যা অন্যান্য সময় আদায় করা হয় না।[ফাতহুল বারী ১/২৬৩]

■শিক্ষা ও মাসায়েলঃ
❏ তাওবা করাঃ
যিলহজ মাসের ১ম দিনগুলোতে তাওবা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
-হে মোমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর—বিশুদ্ধ তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সে দিন আল্লাহ লজ্জা দেবেন না নবীকে এবং তার মোমিন সঙ্গীদেরকে, তাদের জ্যোতি তাদের সম্মুখে ও দক্ষিণ পার্শ্বে ধাবিত হবে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর, নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।সূরা তাহরীম, আয়াত: ৮]
.
❏ ফরয ও নফল সালাতগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করাঃ
অর্থাৎ ফরয ও ওয়াজিবসমূহ সময়-মত সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী ﷺ। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নত, মোস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। ফরয সালাতগুলো সময় মত সম্পাদন করা, বেশি বেশি করে নফল সালাত আদায় করা। যেহেতু এগুলোই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার সর্বোত্তম মাধ্যম। তাই সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নত, মোস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। হাদিসে এসেছে,
-আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো অলির সঙ্গে শত্রুতা রাখে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা ফরয ইবাদতের চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয় কোনো ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই, আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে কোনো কিছু চাইলে আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায় আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেই। আমি যে কোনো কাজ করতে চাইলে তাতে কোনো রকম দ্বিধা করি না, যতটা দ্বিধা করি মুমিন বান্দার প্রাণ হরণে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে থাকে অথচ আমি তার প্রতি কষ্টদায়ক বস্তু দিতে অপছন্দ করি। [বুখারি হা/৬৫০২]
.
❏ সিয়াম পালন-রোজা রাখাঃ
যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের রোজা রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। যেহেতু অন্যান্য নেক আমলরে মধ্যে সিয়ামও অন্যতম, তাই এ দিনগুলোতে খুব যত্নসহকারে সিয়াম পালন করা।
-হাফসা রা. থেকে বর্ণিত, নবী ﷺ কখনো চারটি আমল পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হল: আশুরার সওম, যিল হজের দশ দিনের সওম, প্রত্যেক মাসে তিন দিনের সওম, ও জোহরের পূর্বের দুই রাকাত সালাত।[আহমদ: ৬/২৮৭, আবু দাউদ হা/২১০৬; নাসায়ী হা/২২৩৬, সনদ সহী]
.
❏ হজ্জ ও ওমরা করাঃ
নবী ﷺ এ দুটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। এ দুটি ইবাদতে রয়েছে পাপের কুফল থেকে আত্মার পবিত্রতা, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হতে পারে। তাই নবী ﷺ বলেন:—
-যে ব্যক্তি হজ করেছে, তাতে কোনো অশ্লীল আচরণ করেনি ও কোনো পাপে লিপ্ত হয়নি সে সে দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে গেল, যে দিন তার মাতা তাকে প্রসব করেছে। [বুখারি হা/১৪৪৯, মুসলিম হা/১৩৫০]
হাদিসে আরও এসেছে—
-আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহকে তার মধ্যবর্তী পাপসমূহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আর কলুষযুক্ত হজের পুরস্কার হল জান্নাত।’ [ বুখারি হা/১৬৮৩, মুসলিম হা/১৩৪৯]
.
❏ আল্লাহর যিকির করা:
এ দিনসমূহে অন্যান্য আমলের মাঝে যিকিরের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, যেমন হাদিসে এসেছে:—
-আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী ﷺ বলেন: এ দশ দিনে [নেক] আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে অধিক প্রিয় ও মহান আর কোনো আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল [লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ] তাকবীর [আল্লাহু আকবার] তাহমীদ [আল-হামদুলিল্লাহ] বেশি করে আদায় কর।[আহমদ হা/১৩২]
.
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন:—
-যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।[সূরা আল-হজ, আয়াত: ২৮]
✍ অধিকাংশ আলেম বলেছেন: এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিন বলতে যিলহজের প্রথম দশ দিনকে নির্দেশ করা হয়েছে। এ সময়ে আল্লাহর বান্দাগণ বেশি বেশি করে আল্লাহর প্রশংসা করেন, তার পবিত্রতা বর্ণনা করেন, তার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেন, কুরবানির পশু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম ও তাকবীর উচ্চারণ করে থাকেন। হাদিসে আছে চারটি বাক্য আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। ১-সুবহানাল্লাহ, ২-আলহামদু লিল্লাহ, ৩-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ৪-আল্লাহু আকবর। এ দিনগুলোতে এ যিকিরগুলো করা যেতে পারে।
.
❏ তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদঃ
এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজার সহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা হবে। তবে মেয়েরা নিম্ন-স্বরে তাকবীর পাঠ করবে। তাকবীর হল:—
اَللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ، لَاإِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ وَلِلهِ الحَمْدُ
সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবু হুরাইরা রা. যিলহজ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও তাকবীর পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবীর পাঠ করতেন। অর্থাৎ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই দুই প্রিয় সাহাবি লোকজনকে তাকবীর পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।[বুখারি, ঈদ অধ্যায়]
ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ইবনে ওমর ও আবূহুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের জন্য বের হতেন, মানুষরাও তাদরে দেখে দেখে তাকবীর বলত। তিনি আরও বলেছেন, ইবনে ওমর মিনায় তার তাবুতে তাকবীর বলতেন, মসজিদের লোকেরা শুনত, অতঃপর তারা তাকবীর বলত এবং বাজারের লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীর বলত। এক পর্যায়ে পুরো মিনা তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত।
ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ দিনগুলোতে মিনায় তাকবীর বলতেন, প্রত্যেক সালাতের পর, বিছানায়, তাঁবুতে মজলিসে ও চলার পথে সশব্দে তাকবীর বলা মোস্তাহাব। যেহেতু ওমর, ইবনে ওমর ও আবূহুরায়রা সশব্দে তাকবীর বলেছেন।
.
❏ আরাফার দিন রোজা রাখাঃ
হজ পালনকারী ছাড়া অন্যদের জন্য আরাফার দিন রোজা রাখা। আবু কাতাদাহ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ কে আরাফার দিনের রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,
-আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, ইহা পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছররে গুনাহর কাফফারা হবে। মুসলিম হা/১১৬৩]
.
❏ পশু কোরবানী করাঃ
হাদিসে এসেছে—
-আব্দুল্লাহ ইবনে কুরত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহর নিকট দিবসসমূহের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হল কুরবানির দিন, তারপর পরবর্তী তিনদিন।[আবু দাউদ হা/১৭৬৫]

সৌজন্যে: কোরআনের আলো

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর