আবারও উঠল বঞ্চনার অভিযোগ, নেট সেট জেআরএফ পাশ করা সত্ত্বেও পিএইচডির সংরক্ষিত আসনের জন্যও অযোগ্য ঘোষণা সংখ্যালঘুদের

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

bg-1624197078

~সুলেখা নাজনিন

রাজ্যের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষদের সরকারি চাকরিতে চাকরির সুযোগ করে দিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়র প্রচেষ্টায় রাজ্য সরকারের চাকরিতে ওবিসি-এ সংরক্ষণ ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আর ওবিসি- সংরক্ষণ ৭ শতাংশ। মূলত সংখ্যালঘুদের সুযোগ করে দিতে ওবিসি-এ সংরক্ষণ ১০ শতাংশ করা হয় রাজ্যে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর। উল্লেখ্য, এই ওবিসি-এ তালিকাভুক্তদের সবাই সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য সরকারি চাকরিতে ওবিসি সংরক্ষণ বাস্তবায়নের নির্দেশ দিলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ওবিসি সংরক্ষণকে বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে। সম্প্রতি সেই ধরনের ওবিসি বঞ্চনার এক অভিযোগ উঠেছে রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি-তে ভর্তির জন্য যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল তাতে ইতিহাস বিভাগের জন্য একটি করে আসন ওবিসি-এ এবং ওবিসি-বি এর জন্য সংরক্ষিত ছিল। দেখা যায় ওবিসি আসনে বহু নেট-সেট এমনকী জেআরএফ উত্তীর্ণরা আবেদন জানান। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের নেওয়া ‘রেট’ পরীক্ষার মাধ্যমেও কয়েকজন ইন্টারভিউয়ের সুযোগ পান। কিন্তু ইতিহাসে পিএইচ করার জন্য যে ফল প্রকাশিত হয় তাতে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে জানানো হয় কোনও যোগ্য ওবিসি-ও ও ওবিসি-বি  প্রার্থী নেই। ফলে, বাম আমলের মতো তৃণমূল সরকারের আমলেও ওবিসিদের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ উঠল।

এ বিষয়ে জানা গেছে, রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা দফতরে আওতাধীন কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের তরফে ২০২০-২১ বর্ষে পিএইচডি-তে ভর্তির জন্য ২৯ এপ্রিল, ২০২১ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে মোট আটারোটি বিষয়ে ১০০টি আসনের জন্য ভর্তির আবেদন করার কথা বলা হয়। সেই মতো বিভিন্ন বিষয়ে প্রার্থীরা আবেদন জানান। ওই বিজ্ঞপ্তিতে ইতিহাস বিভাগের জন্য আট আসনে প্রার্থী চাওয়া হয়। তার মধ্যে চারটি সাধারণ, দুটি এসসি, একটি ওবিসি-এ এবং একটি ওবিসি-বি। ইউজিসির নিয়ম অনুযায়ী যারা নেট, সেট, জেআরএফ উত্তীর্ণ তারা সরাসরি ইন্টারভিউয়ের সুযোগ পান। আর লিখিত পরীক্ষা ‘রিসার্চ এলিজিবিটি টেস্ট’ বা রেট-এ উত্তীর্ণরা ইন্টারভিউয়ের সুযোগ পান। সেই মতো গত ১১, ১২ ও ১৩ জুন ইন্টারভিউ পর্ব শেষে ১৬ জুন চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়। সেই ফলাফলে দেখা যায় সাধারণ ক্যাটেগরিতে নির্ধারিত চারটি আসনের জন্য চারজন ও এসসি ক্যাটেগরিতে দুজনের নাম প্রকাশ করা হলেও ওবিসি-এ ও ওবিসি-বি এর ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ‘NFS ( Not Found Suitable)’। অথচ, ওবিসি-ও এবং ওবিসি-বি তালিকাভুক্ত যাদেরকে পিএইচডিতে ভর্তির ইন্টারভিউতে ডাকা হয়েছে তাদের অনেকেই নেট, সেট এবং জেআরএফ উত্তীর্ণ। কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ইতিহাসে পিএইচডি করার জন্য যে ২৬জন ওববিসি-এ প্রার্থীকে ইন্টারভিউতে ডাকা হয়েছিল তাদের মধ্যে ২০জন নেট, সেট অথবা জেআরএফ উত্তীর্ণ। আর বাকি ৬ জন ‘রেট’ পরীক্ষা উত্তীর্ণ। অপরদিকে, ওবিসি-বি প্রার্থী ছিলেন ২৪ জন। এরা সবাই হয় নেট, সেট কিংবা জেআরএফ উত্তীর্ণ। দুটি ক্ষেত্রেই একজন করে প্রার্থী যোগ্য বলে মনে করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে, কোন যুক্তিতে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত ওবিসি সংরক্ষিত আসনে পিএইচডি করার প্রার্থী খূঁজে পেলেন না কমপক্ষে নেট. সেট, জেআরএফ কিংবা রেট উত্তীর্ণদের মধ্যে থেকে তা নিয়ে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে। তাই কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে জাতি বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, ওবিসিদের সুযোগ বঞ্চিত করতে এটি একটি চক্রান্ত মাত্র। তাদের অভিযোগ, এভাবে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না বলে দেখানো গেলে পরবর্তীতে সংরক্ষিত আসনটি সাধারণের জন্য মুক্ত করা দেওয়া হতে পারে। এভাবেই রাজ্যের পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর শ্রেণির পড়ুয়াদের উচ্চ শিক্ষার পথে অন্তরায় করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওবিসি-এ ক্যাটেগরিতে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্তি থাকলেও ওবিসি-ব তে প্রায় সিংহভাগই পিছিয়ে পড়া হিন্দু সম্প্রদায়ই অন্তর্ভুক্ত। তাই পিছিয়ে পড়া হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদেরে এভাবে উচ্চশিক্ষার পথ অবরুদ্ধ করে দেওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।

এব্যাপারে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি-র জন্য আবেদনকারী বহু ওবিসি-এ প্রার্থী হতাশ হয়ে পড়ছেন। কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ফল ঘোষণার পর বৈষম্যের অভিযোগ ওঠায় ‘আপনজন’ কিছু প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে, যারা নেট, নেট, জেআরএফ অথবা রেট উত্তীর্ণ হয়েও ইতিহাসে পিএইচডি করার সুযোগ বঞ্চিত হয়েছেন।এ ‘বৈষম্যের’ শিকার হওয়া এক প্রার্থী আরিফ হোসেনের বাড়ি মুর্শিদাবাদের সুতি ব্লকের অরঙ্গাবাদ এলাকায়। বর্তমানে হরিণঘাটা মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আরিফ হোসেন বলেন, তিনি নেট, সেট ও জেআরএফ উত্তীর্ণ। এরপরেও তার মতো প্রার্থীরা পিএইচডি করার সযোগ বঞ্চিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনেছেন। আরিফ বলেন, কমপক্ষে জেআরএফ প্রার্থীদের সুযোগ দেওয়া হলে তারা গবেষণার জন্য ৩৩ হাজার টাকা করে ভাতাও পেতেন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে। সেটাও হাতছাড়া হল। একই বক্তব্য, অন্য প্রার্থী শামসেরগঞ্জের সোহেল রানা, সুতির আবদুল্লাহ, ফরাক্কার আলাউদ্দিন সেখেরও।

আর জানা গেছে, ইতিহাসে পিএইচডি করার ইন্টারভিউয়ে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন ওবিসি-এ এবং ওবিসি-বি মিলিয়ে মোট ২৭ জন মুসলিম। এদের মধ্যে তিনজন মহিলা। তারা হলেন নাজিয়া ফিরোজ, রূপা খাতুন ও রুকাইয়া জোহরা। এদের মধ্যে নাজিয়া ফিরোজ নেট, সেট বা জেআরএফ উত্তীর্ণ হওয়ায় সরাসরি ইন্টারভিউয়ের সুযোগ পান। আর রূপা খাতুন ও রুকাইয়া নজরুল বিশ্বদ্যিালয় আয়োজিত ‘রেট’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় ইন্টারভিউ দেওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা বিফলে যায়। এ ব্যাপারে পূর্ব বর্ধমানের কালনার মেয়ে রূপা খাতুন ‘আপনজন’কে জানান, বহু কষ্ট করে ‘রেট’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পিএইচডি করার সুযোগ মিলল না। তাহলে, পিছিযে পড়া সমাজের মেয়েরা কি উচ্চশিক্ষা বঞ্চিত হয়েই থাকবে। সেই প্রশ্ন এখন রূপার কাছে। রূপার আশা, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বিষয়টি তুলে ধরতে পারলে হয়ত সুরাহা হতে পারে। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই রাজ্যের সংখ্যালঘুদের ওবিসি-এ তালিকা ভুক্ত করে সরকারি চাকরিতে সংখ্যালুঘুদের সুযোগ করে দিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই রাজ্য সরকার পরিচালিত কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এহেন আচরণে হতাশ রূপা খাতুন।

ষয়টি নিয়ে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাধন চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।উল্লেখ্য,  সংখ্যালঘুদের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সাচার কমিটি গঠিত হয়েছিল। ২০০৬ সালে সেই সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি মুখ পোড়ে তৎকালীন পশ্চিমবাংলার বাম সরকারের। কারণ, দীর্ঘ বাম শাসনে সরকারি চাকরিতে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের অংশিদারিত্বের হার একেবারে তলানিতে ঠেকে যায়। ২০০১ জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যার হার ২৫.২ শতাংশ হলেও কমিটির রিপোর্ট অনুয়ায়ী সব শ্রেণির রাজ্য সরকারের চাকরিতে মাত্র ৩.৪ শতাংশ মুসলিমের উপস্থিতি থাকে। সাচার কমিটির রিপোর্ট জানায়, রাজ্য সরকার চাকরিতে গ্রুপ এ ও বি-তে মুসলিমদের হার ৪.৭ শতাংশ। আর গ্রুপ সি ও ডি শ্রেণিতে শ্রেণিতে ২.১ শতাংশ মুসলিম চাকরি রত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই বেহাল দশার কথা সাচার কমিটি তুলে ধরলেও তৎকালীন বাম সরকার সেই রিপোর্ট মানতে চাননি। তৎকালীন রাজ্যের সংখ্যালঘু মন্ত্রী আবদুস সাত্তার যিনি বর্তমানে কংগ্রেসের সেসময় সাচার কমিটির রিপোর্টে গরমিলের অভিযোগ তোলেন। যদিও সাচার কমিটির রিপোর্ট পরিষ্কারভাবে সেসময় উল্লেখ করা হয়, এই যে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের করুণ দশা তাতে বাদ গিয়েছে শিক্ষা দফতরের হিসাব। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বরাষ্ট্র দফতরও পরিবহণ দফতরে মুসলিমদের উপস্থিতির হার জানালেও শিক্ষা দফতর ও স্বাস্থ্য দফতরের হিসাব দেয়নি। ফলে, তৎকালীন শিক্ষা দফতরে মুসলিমদের হার নিয়ে প্রকৃত অবস্থান জানা যায়নি। তবে, সার্বিকভাবে রাজ্য সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের হার খুব কম থাকার মাশুল গুনতে হয়েছে বাম সরকারকে। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান হয়েছে। যে বাম শাসনে মুসলিমরাই ভোট ব্যাঙ্ক ছিল, তারাই হয়ে ওঠেন তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক। আর দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পর রাজ্যে তৃণমূল সরকার আসে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি মতো ওবিসি-এ তালিকাভুক্তদের সরকারি চাকরিতে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ ঘোষণা করে সংখ্যালঘুদের এগিয়ে আসার সুযোগ করে দেন। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে সংখ্যালঘুদের উত্তরণের পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে।

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় আপনজন অনলাইনে। শুধুমাত্র শিরোনাম পরিবর্তন করা হয়েছে। মূল লেখাটি এখানে ক্লিক করে পাওয়া যেতে পারে।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর