Saturday, April 19, 2025
33 C
Kolkata

লালা, বাংলা ছেড়ে পালা…..একটি অরাজনৈতিক লেখা

~মুদাসসির নিয়াজ

তখন বামেদের সূর্য মধ্যগগণে। তখন কাস্তের ধার ব্লেডের থেকেও বেশি। গোটা রাজ্যই তখন একরকম লাল-গড়। ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসের এমনই এক দিনে তদানীন্তন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বর্ষীয়ান বিমান বসু হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, লালা বাংলা ছেড়ে পালা।

উল্লেখ্য, লালা পদবিধারী মাননীয় অমিতাভবাবু ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি। ওই সময় একদিন হাইকোর্টে আসতে গিয়ে বামেদের মিছিলের জেরে যানজটে দীর্ঘক্ষণ গাড়িতে আটকে ছিলেন। সেদিনই আদালতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, কলকাতায় কাজের দিনে মিটিং-মিছিল বন্ধ করা উচিৎ।

যা নিয়ে বঙ্গ রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তবে বিশেষ করে প্রবীণ সিপিএম নেতা বিমান বসুর ‘লালা বাংলা ছেড়ে পালা’ – এহেন তীর্যক স্লোগান বিচারপতি অমিতাভ লালাকে বাংলার ঘরে ঘরে বহুল পরিচিত করে তোলে। যদিও পরে এমনতর নেতিবাচক বিশেষণ প্রয়োগের কারণে আদালতের কাছে ক্ষমাও চাইতে হয়েছিল বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা বিমান বসুকে।

তবে আমার এই লেখার প্রতিপাদ্য প্রয়াত বিচারপতি কিংবা বিমান বসু নয়। আমি এখন লিখছি লালা বা থুতু বিষয়ে। সেই প্রসঙ্গেই মনে হল, বিমানবাবু বিচারপতি লালাকে বাংলা ছেড়ে পালানোর নিদান দিয়ে বিতর্কে জড়ালেও, আমিও ১৯ বছর পর আজ সেই একই পরামর্শ দিচ্ছি। তবে আমার এই ফরমান হল আমাদের মুখ নিঃসৃত লালা বা থুতুর প্রতি। সহৃদয় পাঠকবর্গ যাতে ভুলবশত আমাকেও আদালত অবমাননার পর্যায়ে না ফেলেন, সেজন্য এই গৌরচন্দ্রিকার অবতারণা।

এবার আসল কথায় আসি :
ইদানীং গলি থেকে রাজপথ ঢেকে যাচ্ছে জনপদের মুখ। গ্রাম থেকে শহরতলির রাস্তাঘাট ক্রমশই মোটা হয়ে যাচ্ছে। হাওড়ায় বাস থেকে নামলে পা পিছলে যাবার উপক্রম। সরকারি, আধা সরকারি অফিস-কাছারির দেওয়াল থেকে মেঝে – সর্বত্রই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই তরল বর্জ্যপদার্থ। কল্লোলিনী কলকাতার অন্যতম অহংকার ও অলঙ্কারে পরিণত হয়েছে পান পরাগ, গুটকা, তিরঙ্গা, শিখর, বিমল, রজনীগন্ধা, মুসাফির ইতাদি প্রভৃতি ব্র্যান্ডের জর্দা ও মশলা-সুপারি। গোগ্রাসে এসব চিবিয়ে জাবর কেটে কুলকুচি করে ফেলে দেওয়া হচ্ছে যত্রতত্র। কিন্তু এই নাতি-তরল নিঃসৃত হচ্ছে আমাদের মুখগহ্বর থেকে। নিত্যদিন কতশত মানুষ গুটকা সংস্কৃতিতে গা ভাসাচ্ছে। কিন্তু আমরা জানি না, পরাগ-গুটকা চিবিয়ে ফেলার সময় আমাদের শরীরের কত না উপকারী জিনিস ক্ষয় করছি।

ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত অনেকেই যেখানে সেখানে থুথু ফেলে। অনেক দেশেই এটি সামাজিক অপরাধ, শুধু অভদ্রতা বা অসামাজিকতার বহিঃপ্রকাশই নয়, এখান থেকে অনেক রকম রোগ সংক্রমনের আশঙ্কাও থাকে। থুতু বা লালা সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। লালার মধ্যে ৯৮ ভাগ পানি থাকে, বাকি ২ ভাগের মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এনজাইম, মিনারেলস ও জীবাণু ধ্বংসকারী উপাদান।

চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, মানুষের মুখের লালা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিদিন আমাদের মুখে প্রায় এক থেকে দেড় লিটার লালা উৎপন্ন হয়ে থাকে। আমরা অনেকে এটিকে শুধু মুখ ভিজিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান বলে মনে করে থাকি। কিন্তু এ ছাড়াও লালার মধ্যে রয়েছে নানাবিধ উপকারী গুণাবলী। লালা একটি আঠালো বা পিচ্ছিল বর্ণহীন তরল। এটি আমাদের কাছে মূলত থুতু হিসেবেই পরিচিত। যা আমাদের মুখের লালা গ্রন্থিতে উৎপন্ন হয়।

আমাদের মুখের দু-পাশে তিন জোড়া বড় লালাগ্রন্থি বা Saliva Gland রয়েছে। এছাড়াও ছোট ছোট আরও অনেক লালাগ্রন্থি রয়েছে আমাদের মুখে। এসব গ্রন্থি থেকে প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় লালা উৎপন্ন হয়ে থাকে। আমাদের লালায় থাকে প্রায় ৯৮% পানি, শ্বেত রক্তকণিকা, মিউকাস, এপিথেলিয়াল কোষ, বিভিন্ন এনজাইম এবং এন্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান। এসব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়েই গঠিত হয় লালা।

এই লালা নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত মানব দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর নির্বিকল্প কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হল- আমাদের পরিপাকতন্ত্রের একটি অপরিহার্য উপাদান। আমরা প্রথমে যখন কোন খাবার খাওয়ার জন্য মুখে দিই তখন সর্বপ্রথম লালা এই খাবারের সাথে মিশ্রিত হয়ে একে পিচ্ছিল করে। ফলে আমরা খুব সহজে খাবার চিবিয়ে গিলতে পারি। লালা না থাকলে খাবার পিচ্ছিল হত না এবং আমরা অনায়াসে গিলতে পারতাম না।

আমরা বিভিন্ন ধরনের খাবার খেয়ে থাকি। এসব খাবারের মধ্যে যেমন নরম বা তরল জাতীয় আছে, তেমনি কিছু খাবার আছে যেগুলো শক্ত এবং শুষ্ক। এসব খাবার খাওয়ার সময় লালা মিশে গিয়ে খাবারকে নরম বা সহজপাচ্য করে তোলে, যা পরবর্তীতে হজমে সহায়তা করে।

লালার জীবাণু-প্রতিরোধী ক্ষমতা আছে। মুখের ভেতরকার জীবাণুকে মেরে ফেলতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আমাদের মুখে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে খাবার খাওয়ার সময় খাবারের সাথে অসংখ্য জীবাণু আমাদের মুখে প্রবেশ করে থাকে, যা আমাদের পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা সহ নানা রকম ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু খাদ্যদ্রব্য চিবানোর সময় খাবারের সাথে লালা মিশ্রিত হয়ে অধিকাংশ জীবাণু ধ্বংস করে আমাদের পরিপাকতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।

আমাদের মুখে এবং পরিপাকতন্ত্রে বিভিন্ন এনজাইমকে সক্রিয় রাখতে হলে অ্যাসিডের সমতা থাকতে হয়। লালা আমাদের মুখে অ্যাসিডের সমতা রক্ষা করে। ফলে আমাদের মুখের এনজাইমগুলো সদাক্রিয় থাকতে পারে।
আমরা যে সব খাবার খেয়ে থাকি, তার মধ্যে বেশিরভাগ হল শর্করা এবং চর্বি জাতীয়। তবে এ জাতীয় খাবার খুব দ্রুত হজম হতে চায় না এবং এদেরকে জটিল খাদ্য উপাদান বা Complex Food বলে।

খাওয়ার সময় এসব খাবারের সাথে মিশ্রিত লালা এই জটিল খাদ্য উপাদানগুলো ভেঙে সরল খাদ্য উপাদানে পরিণত করে। ফলে শর্করা বা চর্বি জাতীয় (Carbohydrate & Fat) জটিল খাবারগুলো হজমের উপযোগী হয়ে ওঠে।
লালায় থাকা বিভিন্ন এনজাইম দাঁতের ক্রেইভাসের মধ্যে আবদ্ধ খাদ্য কণাগুলি ভেঙে ফেলার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রাখে। এতে করে দাঁত ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। দাঁতকে ধৌতকরণ, মুখের মধ্যকার জীবাণু নিয়ন্ত্রণ, মুখ পরিষ্কার, মুখের মধ্যকার বিব্রতকর গন্ধ নিয়ন্ত্রণসহ দাঁতকে মজবুত রাখতে সাহায্য করে লালা।

মুখের মধ্যকার নরম অংশকে খাবারের ঘর্ষণ থেকে রক্ষা করে লালা। তাই লালা নিঃসরণ কমে গেলে মুখে নানা ধরনের জ্বালাপোড়া ও কষ্ট শুরু হয়। লালাতে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম থাকে। এদের মধ্যে অ্যামাইলেজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই এনজাইমটি লালার মধ্যে থাকায় খাদ্যের হজম প্রক্রিয়া আমাদের মুখে থেকেই শুরু হয়ে যায়। অ্যামাইলেজ ম্যাল্টোজ, স্টার্চ এবং ডেক্সট্রোস এর মত বৃহৎ ও জটিল খাদ্য উপাদানকে ভেঙে ছোট ও সরল অণুতে পরিণত করে, যা হজমের জন্য প্রক্রিয়া দ্রুত ও সহজ করে দেয়।

লালাতে ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ফ্লোরাইড সহ আরও কিছু মিনারেলস বা খনিজ উপাদান থাকে। এসব খনিজ পদার্থ দাঁতের এনামেলকে পুনর্গঠন করে এবং দাঁতকে শক্ত, মজবুত করে ক্যাভিটি থেকে রক্ষা করে।

লালা বা থুতু হল এক ধন্বন্তরি ঔষধ। কারণ, এতে ঔষধি গুণ প্রচুর মাত্রায় রয়েছে। এই লালা তৈরি করতে প্রায় এক লক্ষ গ্রন্থি নিরলস কাজ করে চলেচে। কেবলমাত্র কফ বেশি হলে তখনই থুতু ফেলা সঙ্গত। এছাড়া লালা কখনো থুতুর মাধ্যমে ফেলতে নেই। সকালের লালা খুব ক্ষারীয় হয়ে থাকে। তাই সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়ে মুখের লালা সবথেকে বেশি উপকারী। এজন্য সকালের লালা শরীরের ভিতরে প্রবেশ করা অবশ্যই দরকার। জীবজন্তু, পশুপ্রাণীরা তাদের শরীর নিজেরাই চেটে চেটে শুধুমাত্র লালার সাহায্যেই অনেক রোগ সারিয়ে ফেলে।

লালার মধ্যে ১৮ রকমের পৌষ্টিক গুণ থাকে, যেগুলো মাটির নীচে থাকে। চোখে সকালের বাসিমুখের লালা নিয়মিত লাগালে দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি পায়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার ৪৫ মিনিট পর থেকে মুখের লালার ক্ষারত্ব কমতে থাকে। তাই ঘুম থেকে উঠে সবার আগে লালার ব্যবহার করে নিন।
প্রতিদিন সকালে দেড় বা দু-গ্লাস পানি বাসি মুখের লালাসহ নিয়মিত পান করা দরকার। এছাড়া নিয়ম করে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ গ্লাস পানি পান, চিনিমুক্ত চুইংগাম চিবানো, লালা গ্রন্থির বিভিন্ন রকম ব্যায়াম, সকাল ও রাতের শেষ খাবারের পর নিয়মিত দাঁত ও মুখ পরিষ্কার রাখা খুবই জরুরী।

সবশেষে বলি, খবরদার! কেউ যেন ভুলেও বলবেন না, লালা মুখ থেকে পালা। বরং বলতে পারেন, লালা বাংলা ছেড়ে পালা।

Hot this week

আদালতের নির্দেশে ভাঙল নির্মাণ, অভিযোগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার

নির্মাণ সংক্রান্ত নিয়মভঙ্গের অভিযোগে মধ্যমগ্রামে এক ব্যক্তির বাড়ি ভাঙল...

এই শহর গর্বিত : জিব্রাল্টার প্রণালী জয় করলেন বাংলার জল-কন্যা সায়নী দাস

বাংলার জলে ভেসে বেড়ানো এক সাহসিনী, যিনি একের পর...

আজ মুর্শিদাবাদে রাজ্যপাল ও জাতীয় মহিলা কমিশন

আজ, শনিবার, প্রশাসনিক ও সামাজিক দিক থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ...

চাকরিহারা শিক্ষকদের লড়াইকে সংহতি না জানিয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উক্তি “আমায় রাজনীতিতে জড়াবেন না”

কলকাতা: রাজ্যে চাকরি বাতিলের ঘটনায় উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সুপ্রিম...

Topics

আদালতের নির্দেশে ভাঙল নির্মাণ, অভিযোগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার

নির্মাণ সংক্রান্ত নিয়মভঙ্গের অভিযোগে মধ্যমগ্রামে এক ব্যক্তির বাড়ি ভাঙল...

আজ মুর্শিদাবাদে রাজ্যপাল ও জাতীয় মহিলা কমিশন

আজ, শনিবার, প্রশাসনিক ও সামাজিক দিক থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ...

দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে চলন্ত বাসে আগুন! জানালা ভেঙে প্রাণে বাঁচলেন যাত্রীরা

বৃহস্পতিবার রাতে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর ওপর ঘটে গেল এক...

গাজায় আবারও রক্তঝরা দিন, খান ইউনুসে একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

গাজায় খান ইউনুস এলাকায় ইসরায়েলের একটি বিমান হামলায় একই...

Related Articles

Popular Categories