Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on email

আজ ঐতিহাসিক মে দিবস। শ্রমিকের অধিকার সুনিশ্চিত করেছে ইসলাম

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

may-day-worker-day

~মুদাসসির নিয়াজ


শত বছর আগে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পুঁজিবাদীদের হাতে নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত হত অহরহ। সেই জুলুম নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে মালিকপক্ষের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে সংঘবদ্ধ হতে থাকে শ্রমিক-মজুররা। শুরু হয় অধিকারের দাবিতে আপসহীন আন্দোলন। সেই মানবিক আন্দোলন দমন করতে পাশবিক বলপ্রয়োগ করা হলে শত শত নিরীহ শ্রমিক নিহত হয়। এরপর বিভিন্ন দেশে কনভেনশন, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হতে হতে এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিকভাবে পয়লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতী পায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন মর্যাদার সঙ্গে দিনটি পালন করে। সবাই এদিন শ্রমিক-মজুরদের জন্য বড় বড় কথা বলে, আশ্বাস দেয়। অথচ বাস্তবে শ্রমিকদের তিমির একবিন্দুও বদলায়নি। আজও তারা সমাজের চোখে হীন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। পুঁজিবাজার বা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ধনীদের ওপরে উঠার জন্য সিঁড়ির ভূমিকা পালন করে এই শ্রমিককুল। কিন্তু বিশ্ববাজারে তারা আজও কোণঠাসা, আজও তারা প্রান্তিক।

একমাত্র ইসলাম দিয়েছে শ্রমিকদের যথাযথ সম্মান, অধিকার ও মর্যাদা। একইসঙ্গে মালিকপক্ষকেও আদল ইনসাফের জোরালো তাগিদ দিয়েছে। যে ব্যক্তি কর্মোদ্যোগের মাধ্যমে স্বনির্ভর বা স্বাবলম্বী হয়, এমন শ্রমিক তথা শ্রমজীবী মানুষ আল্লাহর কাছে ভীষণ প্রিয়। হাদিসে আছে, ‘শ্রমজীবীরা আল্লাহর বন্ধু’। উল্লেখ্য, ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা আল্লাহর, আর মানুষ তার তত্ত্বাবধায়ক বা খিদমতগার। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষের কাছে পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ আমানত হিসেবে রেখেছেন আল্লাহ। অর্থাৎ ধনসম্পদের একছত্র মালিক কোনো মানুষ হতে পারে না। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে মালিক-শ্রমিক সবাই ভাই ভাই। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা-স্নেহ, সৌহার্দ ও বিশ্বস্ততায় ভরপুর।

ইসলামী শ্রম আইন মোতাবেক, শ্রমিক ও মালিক উভয়ের অধিকার রয়েছে নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার। উভয়কে বলা হয়েছে নিজ নিজ কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল হতে। শুধু মালিক বা শুধু শ্রমিক নয়; বরং উভয়কে সুসংহত ও পরিপূরক আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম শ্রমের শ্রেণিবিন্যাসকে স্বীকার করলেও মানবিক মূল্যবোধ ও মৌলিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবাই সমান। রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্যবসা, কৃষি ও দ্বীনচর্চাকে উৎসাহিত করেছেন। আবার সোচ্চারে ঘোষণা করেছেন, মানবিক মর্যাদার ক্ষেত্রে শ্রমিক-মজুর সবাই সমান। ইসলাম শ্রমিককে বলেছে দক্ষ, বিশ্বস্ত ও দায়িত্ববান হতে।

নিয়োগদাতা শোয়াইব (আ.)-এর সঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্ত মুসা (আ.)-এর মজুরি নির্ধারণের বিবরণ এসেছে কুরআনে। পরে উভয়ের সম্মতিতে প্রথমেই মজুরি নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ। ইসলামী শ্রমনীতির শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে, ইসলাম মালিক ও শ্রমিকের জন্য অভিন্ন অন্ন-বস্ত্রের নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশনার আলোকে বোঝা যায় ইসলাম একটি উচ্চ মানসিকতাসম্পন্ন শ্রমনীতির কথা বলেছে, যেখানে শ্রমিকের মানসম্মত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন মাত্র। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তাই খাওয়ায় যা সে নিজে খায়; সেই বস্ত্র পরিধান করায়, যা সে নিজে পরিধান করে। শ্রমিক-কর্মচারীকে তার সামর্থ্যের অধিক কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয়, তাহলে সে (মালিক) যেন তাকে সাহায্য করে। (বুখারি, হাদিস: ৫৬১৭)

সম্মানজনক বেতন ও পারিশ্রমিক কর্মজীবীর অধিকার। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক মিটিয়ে দাও। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৪৪৩০) মহানবী (সা.) বলেন, সামর্থ্য থাকার পরও শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার পরিশোধের ব্যাপারে গড়িমসি বা টালবাহানা করা জুলুম ও অন্যায়। (বুখারি: ২২৮৭ ও মুসলিম) ‘হাশরের দিনে জুলুম অন্ধকার রূপে আবির্ভূত হবে।’ (বুখারি: ২৩১৫)

হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তাদের বিরুদ্ধে থাকব, যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে, মানুষকে বিক্রি করে এবং ওই ব্যক্তি যে কাউকে কাজে নিয়োগ করল, অতঃপর সে তার কাজ পুরা করল; কিন্তু সে তার ন্যায্য মজুরি দিল না।’ (বুখারি) রাসুলে করিম (সা.) আরও বলেন, ‘যদি কেউ কারও ন্যায্য পাওনা অস্বীকার করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন।’ (মুসলিম) আর ঠুনকো অজুহাতে বেতন-ভাতা ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ভয়ংকর অপরাধ। মহানবী (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিপক্ষে থাকব। …আর একজন সে যে কাউকে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার পর তা থেকে কাজ বুঝে নিয়েছে অথচ তার প্রাপ্য দেয়নি। (বুখারি, হাদিস: ২২২৭)

শ্রমিক ও মালিকের সুসম্পর্ক তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন ইসলামের আলোকে শ্রম আইনের নীতিমালা যথাযথভাবে পালিত হবে। এর ব্যতিক্রম ঘটলেই মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্কে তিক্ততা, দ্বন্দ্ব বা অসন্তোষ দেখা দেবে। ফলে মালিকের যেমন কাজে বিঘ্ন ঘটবে, তেমনি ক্ষতিও হবে। একইসঙ্গে শ্রমিকও তার ন্যায্য পাওনা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এ কারণেই প্রিয় নবি (সা.) শ্রমিক নিয়োগ সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন- ‘নিশ্চয় শ্রমিকের মজুরি (কাজের ধরণ ও দায়িত্ব) নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিয়োগ করিও না।’ (মুসলিম)

শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা-অধিকার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর যখন নামায পূর্ণ করা হবে, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়ো; আর আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণ করো, আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।’ (সুরা-৬২ জুমুআহ, আয়াত: ১০) রাসূল (সা.) বলেন, ‘ফরয ইবাদাতগুলোর পরেই হালাল উপার্জন ফরয দায়িত্ব।’ (বায়হাকি, শুআবুল ইমান: ৮৩৬৭, মিশকাত: ২৭৮১) ‘হালাল উপার্জনগুলোর মধ্যে তা সর্বোত্তম, যা কায়িক শ্রমে অর্জন করা হয়।’ (মুসলিম)

উল্লেখ্য, সব নবী-রাসুলগণ কায়িক পরিশ্রম করেই জীবিকা উপার্জন করেছেন। হযরত নুহ (আ.) কাঠমিস্ত্রি বা ছুতারের কাজ করেছেন। হযরত ইদ্রিস (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন। হযরত সুলাইমান (আ.)-এর পিতা নবী ও সম্রাট হযরত দাউদ (আ.) কামারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নবী হযরত শুয়াইব (আ.)-এর খামারে হযরত মুসা (আ.) ৮ থেকে ১০ বছর শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। আর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আমাদের প্রিয় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন।

রমযান মাসে মালিক বা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো শ্রমিকের প্রতি রহম করা, তাঁর কাজের চাপ কমিয়ে দিয়ে তাঁকে ইবাদতে সহায়তা করা। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমযান মাসে তার কাজের লোকের কাজ কমিয়ে সহজ করে দিল, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার হিসাব সহজ করে দেবেন।’ ইসলামি বিধানমতে, শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি হলো তাঁর মৌলিক অধিকারসমূহ তথা ‘খোরপোষ-বাসস্থান এবং শিক্ষা ও চিকিৎসা’।

মুসলিম হিসেবে মালিকের দায়িত্ব হলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তাসহ তাঁর যাবতীয় মৌলিক অধিকার, চাহিদা পূরণ করা। তাঁর ইবাদত ও আমলের সুযোগ করে দেওয়া। বিশেষত রমাদানে সিয়াম, তারাবিহ, ইফতার ও সাহ্‌রির সুযোগ করে দেওয়া। রমাদান শেষে পরিবার-পরিজনসহ ঈদের আনন্দে শামিল হওয়ার ব্যবস্থা করা। ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ বা প্রদান করা।

এমন ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতি একমাত্র ইসলামই দিয়েছে। এই হাদিসে শ্রমিক ও মালিক পরস্পরকে ভাই সম্বোধন করে মূলত ইসলাম শ্রেণিবৈষম্যের বিলোপ করেছে। তবে মালিক বা উদ্যোক্তার মেধা, শ্রম ও সামাজিক মর্যাদাকে অস্বীকার করেনি ইসলাম। চাপিয়ে দেয়নি নিপীড়নমূলক কোনো ব্যবস্থা। বরং তার ভেতর মানবিক মূল্যবোধ ও শ্রমিকের প্রতি মমতা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। যেন সে মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণে মনোযোগী হয়।

শ্রমিক ঠকানো ইসলামের দৃষ্টি জঘন্যতম পাপ। ইসলামের নির্দেশনা হলো, শ্রমিক তার প্রাপ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হলেও মালিক তাকে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবে। বিশ্বব্যাপী শ্রমিক ও মালিকের অধিকার এবং পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষায় কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনাই হোক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপদ সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম উপায়। আল্লাহ তাআলা সবাইকে উল্লেখিত দিকনির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

আপনার মতামত প্রদান করুন!

সর্বাধিক পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর