~হাফিজুর রহমান, আসোসিয়েট এডিটর, এনবিটিভি
৯০ এর শুরুর এক রোববারের সকালে ফোন। ফোনের ওপ্রান্তে কলকাতা পুলিশের বড়কর্তা আয়ান রশীদ খান। রোববারে রুটিন সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠবো, খান বেয়াড়া ফোন সব হিসেব উল্টে দিলো। খান সাব ছিলেন আমাদের বীরভূম জেলার পুলিশ সুপার।
এসপি ২৬শে জানুয়ারি বীরভূম জেলা সদর সিউড়িতে ডিএম আর এসপির দুটি দলে ক্রিকেট ম্যাচ হতো। আমরা এসপি খানের দলে খেলে ডিএম মণীশগুপ্তর টীমকে বারবার হারাতাম। স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হলাম, খানসাব তখন লালবাজারে ডিসিডিডি। উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তা হলেও পুলিশে মিস ফিট শায়েরানা আন্দাজের খান সাহেবের বন্ধু কলকাতার সুনীল, শক্তি প্রকাশ, গৌতম ঘোষ থেকে বোম্বের জাভেদ, শাবানা, শ্যাম বেনেগাল, এমএস সত্থু সবাই। আমিও গুণীজন সঙ্গের লোভে সুযোগ পেলেই খান সাবের সঙ্গে সময় কাটাতাম। ওর গোলপার্কের ফ্ল্যাট এর ড্রইং রুমে দেখি একজন বসে। মুখ চেনা মনে হলেও নাম মনে আসছিলনা। আমার অবস্হা দেখে ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন।

হাই, আই এম সেলিম।সেলিম দুরানী! শুনে শরীরের মধ্যে ৪৪০ ভল্টের শক। সঙ্গে সঙ্গে ফোন আমাদের স্পোর্টস এডিটর জয়ন্ত চক্রবর্তীকে। ইন্টারভিউ এর পারমিশন নিয়ে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করে ফিরলাম। বিকেলে কালান্তরের বিভাগীয় সম্পাদক মুজতবা আল মামুনকে বগলদাবা করে ইন্টারভিউ নিতে বসলাম। এনবিটিভির পাঠকরা হয়তো ভাবছেন কথা হচ্ছে টি ২০ নিয়ে, এর মাঝে সেলিম দুরানি আসছে কি ভাবে! বলছি, একটু সবুর করুন। আমার ছোট মামা ইউনিভার্সিটি ব্লু, খেলা পাগল মানুষটি ক্রিকেট সিজনে কলকাতায় থাকতেন। কলকাতার কোনও টেস্ট মিস করেননি। ফুটবল ক্রিকেট হকি টেনিস সব খেলাই ওস্তাদ। মামার মুখে সেলিমের গল্প শুনেছি। খেলতেন দর্শকদের জন্য। যেদিক থেকে অনুরোধ আসতো সেদিকে ছয় মারতেন। এই ছয় মারার চক্করে পড়ে বার বার আউট হয়েছেন, দল থেকে বাদ পড়েছেন তবুও পাল্টাননি নিজের অভ্যাস। দল থেকে বাদ পড়ায় গাভাস্কারের অনুরোধে ক্যাপ্টেন ওয়ারেকার ওকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিয়ে যান। পরের গল্প ইতিহাস! সেলিমের বলে আউট হন লয়েড আর রিচার্ডস, ভারত ম্যাচ জিতে ফিরে আসে। সেলিমের কাছে শুনেছি কিভাবে ভিনু মানকর ডানহাতি সেলিমকে বা হাতি বানিয়েছিলেন। পতৌদির নবাবের এক চোখে খেলার মতো অসম্ভব হার না মানার অবিশ্বাস্য কাহিনী। সেই থেকে আমি সেলিম দুরানির ফ্যান।
সেলিমের ছায়া দেখেছিলাম ধোনির হেলিকপটর শটে, এখন মিল পাচ্ছি সূর্য কুমার যাদবের ব্যাটিং এ। সূর্য যেমন ওয়াইড বল ও অবলীলায় মাঠের বাইরে পাঠাচ্ছে সেটা কাবিলে তারিফ। কিন্তু সেলিমের মত দর্শকদের অনুরোধে নিয়ে ক্যারিয়ারের পরোয়া না করা ব্যাটিং না মুমকিন। অসম্ভব। এখানেই সেলিম ব্যতিক্রমী।
সাধেই কি গাভাস্কারের সেলিম আঙ্কেল ওয়েওয়ার্ড জিনিয়াস। সেলিম এসেছিলেন ওর অটো বায়োগ্রাফি (আসক মি ফর সিক্স) লেখার কাজে। ঠিক হয়েছিল আয়ান রশীদ ইংলিশে লিখবেন। ভালো বিক্রি হলে বাংলায় অনুবাদ হবে, অনুবাদ করবো আমি। এরপর খান সাবের অকাল মৃত্যুতে কাজটি হয়নি।
যে কথা বলছিলাম, সূর্যের ব্যাটিং সেলিম দুরানীর কথা মনে করিয়ে দিলো। সূর্য যাদব ঝড়। অফসাইডের বলে খোঁচা মারা ক্রিকেটীয় ব্যকরণ এ মানা। সূর্য অফ হোক বা অন যে দিক দিয়ে বল আসুক বলের লাইনে পা নিয়ে গিয়ে মেরে দিচ্ছে। এখানে সূর্য সেলিমকে পেছনে ফেলবে। কিন্তু ক্যারিয়ারের পরোয়া না করে দর্শকদের ফর্মায়েশে ছয় মারার ঝুঁকি নিতে পারবেনা। এখানেই সেলিম অনন্য। সবার থেকে আলাদা।
এবার আসি খেলার কথায়, প্লেয়ারের অভাব নেই আমাদের, কিন্তু ছক না ভাঙ্গার জ্যন্য হারলাম আমরা। টি ২০ তরুণদের খেলা। আমদের দলে বয়স্ক কার্তিক, রাহুল, শামী, অশ্বিন আছ। ওদের জন্য টেস্ট, টি ২০ ফরমাট নয়! অ্যাডিলেডে বল সুইং কম হয়, তা হলে শামি, ভুবনেশ্বর কি করছে? দলে চাহালের মত রিস্ট স্পিনার থাকা সত্বেও খেলানো হলনা। ওদিকে ইংল্যান্ড রিস্ট স্পিনার আদিল রশিদকে খেলিয়ে সূর্যের দামী উইকেট তুলে নিলো। দেশে আমাদের সবথেকে দ্রুতগতির বলার উমরান বসে। উমরান স্ট্যাম্প টু স্টাম্প বল করে অনায়াসে রানের গতি থামিয়ে দিতে পারতো। এখন পোস্টমর্টেম করে লাভ কি? পাওয়ার প্লে তে আমরা বার বার রান তুলতে ব্যর্থ, অথচ সব দলের রেকর্ড আমাদের থেকে ভালো। আসলে আমাদের মাথায় বসে একদল শাখামৃগ। ক্রিকেটের সঙ্গে এদের সম্পর্ক নাই। এখানেই সৌরভকে দরকার ছিল। মনসুর আলী খান পতৌদির মত সৌরভ ও
ম্যান ম্যানেজমেন্টে এক্সপার্ট। কাকে কোথায় কখন খেলাতে হবে সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল।
এখন রাজনীতি করে বোর্ডের সংবিধান পাল্টে মর্কটরা সৌরভ কে ছেটে জায়গা দখল করে রাখলে যা হয় তাই হয়েছে। এখন মাথা চাপড়ে কি হবে। অ্যাডিলেডে পাকিস্তান নিউজলান্ড ম্যাচ শেষে সবসময় হিন্দু মুসলিম করা এক চ্যানেলের সাংবাদিককে এক দর্শক হুশিয়ারী দিয়ে হিন্দু মুসলিম করতে মানা করেছে। এখন ভারত পাকিস্তান ম্যাচ এলেই টেনশন হয়। কে জানে কে কখন পাকিস্তানের সমর্থক বলে দাগিয়ে দেয়! এখন বাংলায় হনুর উৎপাত বেড়ে গেছে। অশিক্ষিতরা চাঁদ তারা দেওয়া ইসলামিক পতাকাকে পাকিস্তানি পতাকা বলে ভুল করে বার বার। দোষ হয় আমার আপনার মত আম জনতার। সময় খারাপ, বারুদের স্তুপে বসে আমরা। সাবধান থাকার দায় আমাদের। খেলার মধ্যে হিন্দু মুসলিম নেই আছে দেশ, এ সত্যি মানুষ যত তাড়াতাড়ি বুঝবে তত মঙ্গল।