মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন সফর নামা (জন্ম ৫ জানুয়ারি, ১৯৫৫-)

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

এনবিটিভি ডেস্কঃ  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতার হাজরা অঞ্চলে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত সনাতন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রমীলেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কলকাতার শ্রীশিক্ষায়তন কলেজ থেকে বি.এ. ডিগ্রি সম্পূর্ণ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে কলকাতার যোগেশচন্দ্র চৌধুরী আইন কলেজ থেকে এলএল.বি. ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনীতিতে প্রবেশ ছাত্রাবস্থাতেই। শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার পর সংসার চালনার জন্য কিছুকাল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছিলেন তিনি।

১৯৭০-এর দশকে অত্যন্ত অল্প বয়সে কংগ্রেস দলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কর্মজীবনের সূচনা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি স্থানীয় কংগ্রেস নেত্রী রূপে পরিচিত হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কংগ্রেস-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে সাংসদ নির্বাচিত হন। সেই সময় তিনি ছিলেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ সাংসদের অন্যতম। এই সময় তিনি সারা ভারত যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র থেকে পুনরায় সাংসদ নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪ ও ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও উক্ত কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৯১ সালে নরসিমা রাও মন্ত্রিসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানব সম্পদ উন্নয়ন, ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিকাশ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী মনোনীত হন। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি তার দলের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-কে সহায়তা করার অভিযোগ আনেন। নিজেকে দলের একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠ বলে উল্লেখ করে তিনি এক “পরিচ্ছন্ন কংগ্রেস”-এর দাবি জানান। কলকাতার আলিপুরে একটি জনসভায় গলায় শাল পেঁচিয়ে আত্মহত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।

১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে মমতা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী একটি মেয়ে ফেলানী বসাককে রাইটার্স বিল্ডিং-এ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাকে নিগৃহীত করার পরে গ্রেপ্তার এবং আটক করে। উল্লেখ্য, ফেলানী বসাককে সিপএম ক্যাডাররা ধর্ষণ করেছিল বলে অভিযোগ ছিল। তিনি সেদিন শপথ নিয়েছিলেন যে তিনি কেবল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঐ বিল্ডিংয়ে পুনরায় প্রবেশ করবেন।

১৯৯৭ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস স্থাপন করেন। ১৯৯৯ সালে মমতা বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে সামিল হন। এই জোট সরকার গঠন করলে তিনি রেলমন্ত্রী মনোনীত হন।

২০০১ সালের প্রথম দিকে একটি রাজনৈতিক মতবিরোধের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনডিএ-র সঙ্গে সম্পর্ক সাময়িকভাবে ত্যাগ করেন।  ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি আবার এনডিএ-তে ফিরে আসেন এবং কয়লা ও খনি মন্ত্রকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো প্রকল্পের বিরুদ্ধে একটি জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে তাকে জোর করে বাধা দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়করা বিধানসভায় ভাঙচুর চালান, পথ অবরোধ করেন এবং অনেক জায়গায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগও করা হয়।

২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে একটি কেমিক্যাল হাব তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণের নোটিশ জারি হয়। মমতা ব্যানার্জী এর বিরোধিতা করেন। সরকার নোটিশটি বাতিল করেন। কিন্তু ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ কৃষকদের ছয়মাসব্যাপী অবরোধ তুলতে পুলিশ তাদের উপর নির্মমভাবে গুলিচালনা করে এবং এতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নন্দীগ্রামের কেমিক্যাল হাব প্রকল্পটি স্থগিত করতে বাধ্য হন।

নন্দীগ্রামে তৃনমূলের আন্দোলন সফল হওয়ার পর ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস অত্যন্ত ভাল ফল করে। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস একাই ১৯টি আসনে জয়লাভ করে। ২০০৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয়বার রেলমন্ত্রী হন।

২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে (মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২২৭টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণ করেন।

২০১৪ সালে ভারতের লোকসভার নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে লড়ে পশ্চিমবঙ্গের ৩৪টি লোকসভা আসনে জয়লাভ করে।

২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে ২১১টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয়বার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন।

অনেকেই ভেবেছিলেন যে, ২০১১ ও ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় যেতে দারূনভাবে সফল হলেও ২০২১ সালের নির্বাচনে তাঁরা ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে হেরে যাবেন। এবং যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তাতে মনেই হয়েছিল এবার ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু এককভাবে ২১৩ টি আসন নিয়ে তৃণমূল পুনরায় জয়ী হয় এবং মমতা ব্যানার্জী তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন।

মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজ সাথী’, ‘স্বাস্থ্য সাথী’ -এরকম প্রকল্পগুলো প্রশংসিত হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি ও নিচুতলার কর্মীদের দাদাগিরির কারণে যথেষ্ট সমালোচিতও তিনি। অনেকের মতে মমতা ব্যানার্জীর আমলেই রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে  মারাত্মকভাবে।

অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে ‘মুসলিম তোষণের’ অভিযোগ এনে বিজেপি রাজনৈতিক মেরুকরণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মুসলিম নেতৃত্বদের মতে, তৃণমূল আমলে হজ হাউজ বা ইমাম প্রশিক্ষণের মতো কিছু প্রতীকী প্রকল্প ছাড়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ রাজ্যে মুসলিম সমাজের তেমন কোনো উন্নতি হয় নি বা সরকারী উদ্যোগও যথেষ্ট নয়।

২০২১ এর সাফল্যের পর দিদির নজর এখন অন্যান্য রাজ্যেও। তৃনমূলের বিস্তার ঘটেছে বিভিন্ন রাজ্যেই। নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছেন গোয়া, আসাম, মনিপুর, ত্রিপুরার মত রাজ্যেও। আশানুরূপ ফল না পেলেও দেশের অন্যতম একটি দল হিসেবে বিবেচিত তৃণমূল। মমতা ব্যানার্জীর পরবর্তী স্বপ্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী। বিজেপির মত শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কি না, তা অবশ্য সময়ই বলবে।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর