৫ দশক গুপ্ত জীবনের পরে গ্রেফতার নকশাল নেতা কিষাণ দা

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

krishan

সৌম্য মন্ডল: দীর্ঘ ৫ দশকের গুপ্ত জীবনের পরে অবশেষে ধরা পড়লেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) দলের প্রবীণ পলিটব্যুরো সদস্য প্রশান্ত বসু ওরফে কিষাণ দা। যাকে মাওবাদী পার্টির সেকেন্ড ম্যান ইন কমান্ড মনে করে ওয়াকিবহল মহল। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবিরে তিনি বিশিষ্ট মাওবাদী তাত্বিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়ে রাজ্য সরকার কিষানদার মাথার দাম রেখে ছিল ৫০ লক্ষ টাকা। ঝাড়খন্ডে তাঁর মাথার দাম এক কোটি টাকা। পুলিশের খাতায় অন্ধ্র প্রদেশের প্রয়াত কিষাণজীর সাথে পার্থক্য করার জন্য পুলিশের কাছে যিনি বাঙালি কিষাণ নামে পরিচিত।

 

সূত্র জানাচ্ছে ১২ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে পুরুলিয়া আসার পথে ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা- খরসোওয়া জেলার কাঁড়রা থানার গিদ্দিবেড়া টোল ট্যাক্স থেকে সিপিআই (মাওবাদী) পলিটব্যুরো সদস্য প্রশান্ত  বসু ও আর এক মাওবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যা শিলা মারান্ডিকে গ্রেপ্তারকরেছে ঝাড়খন্ড পুলিশ। এ ছাড়াও দু-জন ধরা পড়ছেন, তাদের পরিচয় জানা যায়নি। সারা দেশে এই খবর ব্রেকিং নিউজ হলেও, এই প্রবন্ধ লেখা অব্দি খবরের কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি পুলিশ। যদিও বর্তমান প্রতিবেদকের কাছে একটি ভিডিও এসেছে, সে খানে দুই জন বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে সাদা পোষাকে পুলিশের ঘেরাটোপে স্কর্পিও গাড়িতে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।

 

যাদবপুরের বিজয়গড় কলোনির বাসিন্দা প্রশান্ত বসু ৭০ এর দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র জীবনে। পরে বেসরকারি ক্যামিক্যাল ল্যাবরেটরির কর্মচারী প্রশান্ত বসু প্রথমে শ্রমিক কর্মচারীদের আন্দোলনে ও পরবর্তী কালে নকশালবাড়ির ধারায় সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। প্রশান্ত বসু মূলত সক্রিয় ছিলেন অবিভক্ত বিহার বা বর্তমানের ঝাড়খণ্ড-বিহার অঞ্চলে। বিহার, ঝাড়খন্ডে উচ্চবর্ণীয় জমিদার, ধনী ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে কৃষক,মজুর, আদিবাসীদের লাল সন্ত্রাসে সামিল করার বহু অভিযোগ প্রশান্ত বসুর বিরুদ্ধে উঠে আসছে গত ৫০ বছর ধরে। গণ-হিংসার মাধ্যমে উচ্চ বর্ণের জমিদারের জমি লুট করে দলিত কৃষকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া, জঙ্গল থেকে ফরেস্ট অফিসারদের বিতাড়িত করে আদিবাসীদের অবাধ অধিকারে জঙ্গল তুলে দেওয়া, পুলিশ-আধা সামরিক বাহিনীর উপর হামলা সহ বিভিন্ন প্রকার বে-আইনি কার্যকলাপে অভিযুক্ত প্রবীণ এই কমিউনিস্ট নেতা।  রাজনৈতিক সূত্রেই পরিচয়ের পরে প্রশান্ত বসু বিয়ে করেন অবিভক্ত বিহারের আদিবাসী এবং নারী আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী শিলা মারান্ডির সাথে। ওয়াকিবহল মহল মনে করে বিহার থেকে পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের আন্দোলনে শিলা মারন্ডি ছিলেন অন্যতম নেত্রী এবং অনেকে মনে করেন ঝাড়খন্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন যিনি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর বাবা, তাকে তৈরির পেছনেও হাত ছিলো শিলা মারান্ডির। এ ছাড়াও নারী আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী ও বুদ্ধিজীবী হিসেবেও শীলা মারান্ডির পরিচিতি আছে। তিনি ছিলেন সারা ভারত নারী মুক্তি সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদিকা। ১২ বছর জেল খাটার পর ২০১৮ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়েই তিনি আবার আত্মগোপন করে প্রশান্ত বসুর সাথে যোগ দেন আন্দোলনে। সম্প্রতি ঝাড়খন্ডে আদানির প্রজেক্টে ৫৬টি গ্রাম উচ্ছেদ এবং আদিবাসীদের জমির উপর অধিকার আইনের বিরুদ্ধে পপআন্দোলনের পেছনে প্রশান্ত-শীলাদের ভূমিকা দেখেছিলো প্রশাসন।

 

 ২০০৪ সালে মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্রে এবং সিপিআই (এম এল) জনযুদ্ধ, এই দুই পার্টি সংযুক্ত হয়ে সিপিআই (মাওবাদী) তৈরি হওয়ার সময় প্রশান্ত বসু ছিলেন এমসিসি দলের সাধারণ সম্পাদক। ২০০৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রশান্ত বসু ছিলেন মাওবাদী পার্টির পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর সম্পাদক। উল্লেখযোগ্য ২০১১ পর্যন্ত আর এক প্র‍য়াত মাওবাদী নেতা কিষাণজী ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর মুখপাত্র। পূর্বাঞ্চলী ব্যুরোর মধ্যে ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার মতন  “সাত বোন”  রাজ্য গুলো পড়ে। ২০১৮ সালে মাওবাদী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুন্নাপ্পা লক্ষনরাও ওরফে গণপতি পার্টিতে অপেক্ষাকৃত তরুনদের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার নীতি ঘোষণা করে পার্টি কংগ্রেস হওয়ার আগেই স্বেচ্ছায় সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে আসেন। এই নীতি অনুযায়ী প্রশান্ত বসুও পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর সম্পাদক পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে আসেন বলে খবর। ওয়াকিবহল মহল মনে করে যে পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরো সম্পাদক পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে আসলেও ভারতের  আন্দোলনে তার গুরুত্ব ছিলো যথেষ্ট। এখন তার বয়স ৭৬ বছর মতন। আজকে ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের বিস্তারে মূল যাদের ভূমিকা তার মধ্যে একজন প্রশান্ত বসু ওরফে কিষাণ দা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় আজ থেকে ১০ বছর  আগে ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর আধাসামরিক বাহিনীর হাতে মারা গেছিলেন কিষাণজী। ভারত সরকারের ২০২২ সালের মধ্যে মাওবাদী কমিউনিস্ট আন্দোলন নির্মূল করা কর্মসূচির পোষাকি নাম অপারেশন সমাধান। এই অপারেশন সমাধান কে প্রতিহত করতে বাসবরাজ-গণপতি-কিষাণ দা দের নেতৃত্বাধীন মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি অপারেশন “ঘামাসান” ঘোষণা করেছিলেন। বলা যায় প্রশান্ত বসুর গ্রেফতার হওয়া সে দিক থেকে সরকারের দিক থেকে বড় সাফল্য। তবে সুসংগঠক প্রশান্ত বসুর কৃষক আদিবাসীদের মধ্যে সংগঠনের জাল বিস্তার করেছে তা এত সহজে মোদি সরকার  গোটাতে পারে কিনা সেটাই দেখার।

 

কমিটি ফর রিলিজ অফ পলিটিক্যাল প্রিজনার্স এর সহ সাভাপতি বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র শুক্রবার বিবৃতি জারি করে অসুস্থ প্রবীণ রাজনৈতিক কর্মী প্রশান্ত বসুর শারিরীক অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ দুই প্রবীণ রাজনৈতিক কর্মী এবং আরো দুই জন ধৃতের রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।

 

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর