কোনোদিক থেকেই ‘এশিয়ার বৃহত্তম’ নয় নয়ডার এয়ারপোর্ট! মোদি-যোগীর দাবি শুধুই ধাপ্পাবাজি

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

1006926-modi-noida-international-airport-ani

 

সাইফুল্লা লস্কর : ‘এশিয়ার বৃহত্তম বিমানবন্দর উত্তরপ্রদেশে নির্মাণ করতে হবে। এটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আকাঙ্ক্ষা ছিল, আজ সেটাই পুরন হল’। উক্তিতে কংগ্রেস থেকে দলবদল করে গেরুয়া শিবিরে যোগদান করা কেন্দ্রীয় বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রী জতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার। এটি এশিয়াতে এই ধরনের প্রথম দূষণমুক্ত বিমানবন্দর, যা এশিয়ার বৃহত্তম বিমানবন্দর হবে। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী যোগী আদিত্যনাথকে গত ২৩ শে নভেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এমন মন্তব্য করতে শোনা যায়। বিমানবন্দরের শিলান্যাসের পিছনে নির্বাচনের বৈতরণিতে সওয়ার যোগিকে কৃতিত্ব না দিয়ে নিজের ভাগে নিয়ে নিলেন নরেন্দ্র মোদি। বললেন, পূর্ববর্তী রাজ্য সরকার তার কাছে চিঠি লিখেছিল এই বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিতে।

গতকাল উত্তরপ্রদেশের নয়ডার জেবার এয়ারপোর্ট উদ্বোধন করতে গিয়ে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারকদের এমন সব মন্তব্য স্বাভাবিকভাবে পুরোদমে প্রচার করছে জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের সব সংবাদমাধ্যম। এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের চতুর্থ বিমানবন্দরের গৌরব ভারতের হবে, শুনে গর্বে বুক ভোরে উঠেছে আপামর ভারতবাসীর। এর পুরো কৃতিত্ব অন্যদের আগে, নিজেই নিজেকে দিয়েছেন ভারতের প্রধান সেবক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু এটা যে স্বঘোষিত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল বিজেপির রাজনৈতিক অপকৌশলের অঙ্গ যা সম্পূর্ণ মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে প্রচার করা হচ্ছে, তেমন ধারনা উঁকিও দেয়নি করো মনে। কারণ, প্রচারে আছেন দেশের প্রধান সেবক প্রধানমন্ত্রী নিজেই। অবশ্য, দেশের বেশিরভাগ মিডিয়াহাউসগুলো যেহেতু এটা স্বাগর্বে এবং সুউচ্চ আওয়াজে প্রচার করছে তাই প্রশ্ন ওঠার অবকাশ ও নেই তেমন। প্রশ্ন তুললে দেশদ্রোহিতার মামলা খাওয়ার ভয়ও রয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চরম ব্যর্থ আদিত্যনাথের জন্য উত্তর প্রদেশে নির্বাচনের আগে আপাতত এটাই টনিকের মতো কাজ করবে, এটাই ধারণা গেরুয়া শিবিরের নীতিনির্ধারকদের। এই খবর প্রচার হতেই বেইজিং এর বিমানবন্দরের ছবি দিয়ে নয়ডা বিমানবন্দর বলে ভুয়া প্রচার চালাতে শুরু করে দিয়েছে গেরুয়া শিবিরের ভক্ত আইটি সেল এবং তাদের গুরু নেতা মন্ত্রীরা। অন্যদিকে, গেরুয়া শিবিরপ্রেমি মিডিয়া ব্যক্তিত্বগুলো মোদি এবং যোগীর জয়গান করার জন্য আরো এক বিরাট কারণ পেয়ে গেল নয়ডার বিমানবন্দরের শিলান্যাসের ধোঁয়ায়।

এবার আসা যাক আসল কথায়। কিভাবে যোগী এবং মোদি গতকাল উত্তর প্রদেশের গৌতম বুদ্ধ নগরে নির্মিত হতে চলা বিমানবন্দরকে এশিয়ার বৃহত্তম বিমানবন্দর বলে আখ্যায়িত করলেন সেটাই বুঝতে পারছেন না ভক্ত শিবিরের বাইরের অবস্থান করা অনেকেই। কারণ, পরিসংখ্যান বলে এই বিমানবন্দর ২০৫০ সাল পর্যন্ত যা হবে তার থেকেও বৃহৎ আকারের, বেশি যাত্রী যাতায়াত এবং ফ্লাইট পরিচালনায় সক্ষম বিমানবন্দর আছে বর্তমান এশিয়াতে। তাও একটা নয় বেশ কিছু। এবার পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দেখে নেওয়া যাক মোদি যোগীর প্রতিশ্রুত তথাকথিত এশিয়ার বৃহত্তম বিমানবন্দরের সঙ্গে এশিয়ার আর কয়টা বৃহৎ বিমানবন্দরের তুলনামূলক আলোচনা।

আয়তন :

নয়ডায় গত ২৫ শে নভেম্বর তারিখে শিলান্যাস হওয়া বিমানবন্দরটি গড়ে উঠছে মোট ১৩ বর্গকিমি আয়তনের ভূমির ওপর। যার সমস্ত সম্প্রসারণের পর মোট রানওয়ের সংখ্যা হবে ৬ টি।

অন্যদিকে বর্তমান সৌদি আরবের দাম্মামে অবস্থিত কিং ফাহাদ ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দর শুধুমাত্র এশিয়ার নয় বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর(আয়তন) হওয়ার জন্য গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের মালিক। বিমানবন্দরটির বর্তমান আয়তন ৭৮০ বর্গকিমি, যা পুরো নয়ডা শহরের থেকেও ৪ গুন বড়ো। নয়ডা শহরের বর্তমান আয়তন ২০৩ বর্গ কিমি প্রায়।

২০৫০ সালে নয়ডার বিমানবন্দরটির মোট সম্প্রসারিত আয়তন হবে সর্বোচ্চ ৪,৮৮,০০০ বর্গ মিটার। অপরদিকে বর্তমানে বেইজিং এর ডাক্সিং টার্মিনালের আয়তন ৭০০,০০০ বর্গ মিটারের বেশি।

বার্ষিক ফ্লাইটের সংখ্যা :

নয়ডার নির্মীয়মান বিমানবন্দরের কার্যক্রম শুরু হবে ২০২৪ সালে। কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে ২০৩৬-৩৭ সাল পর্যন্ত বিমানবন্দরটি বার্ষিক ৯৬,৪০০ টি ফ্লাইট পরিচালনা করবে বলে জানানো হয়েছে সরকারের তরফে। ২০৫০ সালে বিমানবন্দরের পঞ্চম পর্যায়ের সম্প্রসারণের পর এটির মোট বার্ষিক ফ্লাইট পরিচালনার সক্ষমতা উন্নীত হবে ৪,৮৯,৭০০ টি ফ্লাইটে।

অন্যদিকে এয়ারপোর্ট কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী চীনের দুই বিমানবন্দরের ২০১৬-১৭ সালে পরিচালিত বার্ষিক ফ্লাইটের সংখ্যা ২০৫০ সালে নয়ডার বিমানবন্দরটির থেকেও অনেকটা বেশি।

চীনের রাজধানী বেইজিং ক্যাপিটালস ইন্টারন্যশনাল এয়ারপোর্টের ২০১৬ সালে পরিচালিত বার্ষিক ফ্লাইটের সংখ্যা ছিল ৬,০৬,৬৮৬ টি। অন্যদিকে ২০১৭ সালে সাংহাইয়ের পুদং ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরের পরিচালিত ফ্লাইটের সংখ্যা ছিল ৪,৯৬,৭৭৪ টি।

যাত্রী যাতায়াতের সংখ্যা :

যাত্রী যাতায়াতের সংখ্যার বিচারেও নয়ডার এই বিমানবন্দরের থেকে বেশি যাত্রী ধারন ক্ষমতাসম্পন্ন বিমানবন্দর এশিয়ায় আছে বেশ কয়েকটা। নয়ডার এই বিমানবন্দরটি দিয়ে ২০২৪ সাল থেকে বার্ষিক ১২ মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে বলে আশা সরকারের। ২০৫০ সালে এটির প্যাসেঞ্জার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ৭০ মিলিয়ন হবে বলে জানানো হয়েছে সরকারি সূত্রে।

অন্যদিকে, বেইজিং ক্যাপিটালস ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরের মাধ্যমে ৯৪ মিলিয়নের বেশি যাত্রী যাতায়াত করেছে ২০১৬ সালে। বলছে এয়ারপোর্ট কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট। একই বছরে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ৮৩.৬ মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াতের সাক্ষী থেকেছে। রিপোর্ট অনুসারে, এশিয়ার আরো ৭ টি বিমানবন্দর ৭০ মিলিয়ন যাত্রী হ্যান্ডল করেছে ২০১৯ সালে।

সুতরাং, নয়ডায় নির্মিত হতে চলা জেবার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট কোনো দিক থেকেই এশিয়ার বৃহত্তম বিমানবন্দর হতে যাচ্ছে না। এমনকি ২০৫০ সালেও এই বিমানবন্দরের সক্ষমতার থেকে অনেক এগিয়ে আছে এশিয়ার বেশ কিছু বিমানবন্দর। তাই, ঘটা করে উত্তর প্রদেশের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে কেন এই প্রচারণা চালানো হচ্ছে তার কারণ খুব সহজে অনুমেয়। তবে, প্রচারণায় সমস্যা নেই যদি তা সত্যি এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে, দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই এই মিথ্যার প্রচার চালানো হচ্ছে, যা সুখকর নয় ভারতের মতো এক গণতান্ত্রিক দেশের জন্য। উন্নয়নের থেকে নির্বাচন যে দলের কাছে প্রাধান্য বেশি পায় সে দল এবং মতাদর্শ থেকে এর বেশী কিছু প্রত্যাশা করা বোধহয় তাদের প্রতি জনসাধারণের সাধারন বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর