ধর্মোম্মাদ নয়, তিতুমীর হলেন ব্রিটিশ বিরোধীতায় দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রথম শহিদ

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

The-Great-Patriot-Shahid-Titumir

~মুহাম্মাদ আব্দুল মোমেন

বাঁশের কেল্লার জনক ও বারাসত বিদ্রোহের নেতা শহিদ তিতুমীরকে নিয়ে একবিংশ শতকে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। তিনি নাকি ছিলেন ধর্মম্মাদ ও সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ অনুমোদিত দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ে জনৈক আর এস এস ভক্ত ঐতিহাসিক? লিখেছেন-“তিতুমীরের নেতৃত্বে ওহাবীরা বেশ কিছু মন্দির ধ্বংস করে ও কিছু পুরোহিত হত্যা করেন। তুতুমীরের আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ধর্মোম্মাদদের কাণ্ড”। একজন ধার্মিক, প্রকৃত জনদরদি ও দেশপ্রেমিকের বিরুদ্ধে এই অপবাদের জবাব রয়েছে তাঁরই অকৃত্রিম সংগ্রামী জীবনে। সেই ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রয়াস অত্যন্ত ঘৃণ্য। কেন তাঁকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মম্মাদ বলে অপবাদ দেওয়ার প্রয়াস? তিনি ইংরেজ আশ্রীত জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দরিদ্র হিন্দু মুসলিম কৃষকদের নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই  উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের চিরাচরিত কুটিলতার ফল এই অপবাদ । এখন আমরা দেখব, তিতুমীর এর প্রকৃত জীবনধারার কিছু অংশ।

তিতুমীর এর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। জন্ম ২৭ জানুয়ারি,১৭৮২ এবং মৃত্যু ১৯ নভেম্বর, ১৮৩১ সালে। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী।  ইংরেজ অধিনস্ত জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরূদ্ধে সংগ্রাম এবং তাঁর বিখ্যাতবাঁশের কেল্লার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। ব্রিটিশ সেনাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় এই বাঁশের কেল্লাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

তিতুমীরের জন্ম অবিভক্ত ২৪পরগনার বসিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়া থানার চাঁদপুর- হায়দারপুর গ্রামে । তাঁর পিতার নাম মীর হাসান আলী এবং মাতার নাম আবিদা রোকেয়া খাতুন। তিতুমীরের প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর গ্রামের বিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীকালে তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া সম্পুর্ণ করেন। ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরানের হাফেজ (সম্পূর্ণ কোরান মুখস্থ) এবং হাদিস শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। একইসাথে তিনি বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। পড়াশোনা সমাপ্তকরে কর্মজীবণে প্রবেশ করেন। তিতুমীর বাল্যকাল থেকেই অসীম সাহসি এবং সুদক্ষ মল্লযোদ্ধা ছিলেন। এমনকী জেলার একনম্বর কুস্তিগীর হয়ে উঠেছিলেন। তাই একাধিক জমিদাররা তাঁকে লাঠিয়াল হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। সেইমত জমিদারের লাঠিয়াল হিসেবেই কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেন। কিন্তু কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সাধারণ দরিদ্র কৃষক সমাজের ওপর জমিদারদের অমানবিক অত্যাচার ও শোষণ দেখে বিবেক তাড়িত হয়েপড়েন। অত্যাচারি জমিদারের অধিন চাকরি করাকে মহাপাপ বলে চাকরি ছেড়েদেন।

 

তিতুমীর

১৮২২ সালে তিতুমীর হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা শরিফে গমন করেন। সেখানে ভারত স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃত সৈয়দ আহমেদ শহীদের সান্বিদ্ধে এসে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর অনুপ্রেরণায় ওয়াহাবী মতবাদের অনুসারী হন। হজব্রত সমাপ্ত করে দেশে ফিরে ১৮২৭ সালে তিতুমীর তাঁর গ্রামের অত্যাচারিত দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন।

তাঁর আন্দোলন ছিল তৎকালীন জমিদারদের অত্যাচার ও বহুবিধ কর চাপানোর বিরুদ্ধে। জমিদারদের ফতোয়া ছিল, সকলকে ‘ধুতি’ পরিধান করতে হবে। তিতুমীর সেই নির্দেশের বিরোধিতা করে ‘তাহ্‌বান্দ’ নামে এক ধরনের ইসলামী বস্ত্র পরিধানের নির্দেশ দেন।বিশেষত জমিদার কৃষ্ণদেব রায়-মুসলমানদের ওপর বৈষম্যমূলক কতকগুলি কর আরোপ করেছিলেন। যেমন ‘দাঁড়ি’ রাখার জন্য কর এবং ‘মসজিদ’ এর জন্য কর ইত্যাদি। তিতুমীর এইসব বৈষম্যমূলক নীতি এবং করের তীব্র বিরোধিতা করেন। যারফলে তাঁর অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে।

এইভাবে নীলকর ও নীলকর আশ্রীত জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুমীর সংগ্রামের কথা যত ছড়িয়ে পড়তে থাকে তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যাও দিনে দিনে বেড়ে যেতে থাকে। এক সময়  অনুগামী তথা সহযোদ্ধার সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তিতুমীর তাঁর শিবিরের প্রতিটি সৈন্যকেই মল্যযুদ্ধসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র যুদ্ধে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পারদর্শী করে তোলেন।  তিতুমীরের শক্তিবৃদ্ধিতে দেশীয় জমিদাররা প্রমাদ গুনতে থাকেন। গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রশন্ন মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে জমিদাররা মোল্লারহাটের ইংরেজ কুটিয়াল ডেভিসের শরণাপন্ন হন। ডেভিস জমিদারদের সঙ্গে নিয়ে তিতুমীরকে শায়েস্তা করতে গিয়ে বিপদ দেখে পালিয়ে বাঁচেন। এরপর গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় তাঁকে শিক্ষা দিতে এসে নিজেই শিক্ষা নিয়ে রণে ভঙ্গ দেন। এছাড়াও একাধিকবার স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের কাছে পরাজয় বরণ করে। তারমধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। উইলিয়াম হান্টার বারাসত বিদ্রোহ সম্পর্কে লিখেছেন- “ওই বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন” ।

১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বাদুড়িয়ার নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তিতুমীর বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন।বাঁশ এবং কাদা দিয়ে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এই কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন। এই কেল্লাথেকে চব্বিশ পরগণ, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ

অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীন দেশের ঘোষণা করেন।

তিতুমীরের তৈরি বাঁশের কেল্লার কাল্পনিক চিত্র

অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাঁদের কেল্লাটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর অনুভব করতে পারলেন- দাঁতে দাঁত চেপে মরণবাঁন লড়াই একান্ত আবশ্যক। তাই তিনি আবেগঘণ কন্ঠে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন-“ভাই সব, যেকোন মুহূর্তে ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছে, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে মনে রাখো এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের এই লড়াই থেকে প্রেরণা পাবে এই দেশের মানুষ। আমাদের দেখানো পথে অগ্রসর হয়ে একদিন তারা দেশ উদ্ধার করবে “। কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীরের কেল্লার ওপর আক্রমণ করে।কিন্তু তাঁদের দেশীয় সাধারণ  অস্ত্রশস্ত্র – লাঠি, তির, বল্লাম, তরবারি ইত্যাদি নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেন নি। ১৯ নভেম্বর তিতুমীর ও তাঁর চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তাঁর বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ ওরফে গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এবং বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

অনেক ঐতিহাসিক তিতুমীর এর বীবিক্রমী সংগ্রাম ও আত্মবলিদানকে খাটো করতে তাঁর লড়াই সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় লড়াই আখ্যা দেন। কারণ ঔপনিবেশিক শাসনে ব্রিটিশদের তাঁবেদার কর্মচারী, জমিদার, পেটোয়া ইত্যাদির রমরমা যেমন ছিল, তেমনই ব্রিটিশ উপঢৌকনভূক মোসাহেব এবং লেখক ঐতিহাসিকদের অভাব ছিলনা। ইংরেজদের প্রজা শোষণের ইতিহাস ঘাঁটলে সেই শোষণের পিছনে ভুরি ভুরি এদেশীয় উচ্চবর্গীয় জমিদারদের সহায়তার নজীর পাওয়া যায়। তাঁরা ছিলেন ইংরেজদের সহায়তায় এদেশের দরিদ্র, কৃষক, দলিত ও মুসলিমদের শোষণকারী। সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে মূলত অত্যাচারিতরাই গর্জ উঠেছে। আর সেই অত্যাচারিতদের গর্জে ওঠাকে সন্ত্রাসের তকমাই দেওয়া হয়েছে। এভাবেই জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুর যুদ্ধ – সংগ্রাম  সন্ত্রাসবাদী ও সাম্প্রদায়িকতার তকমা পেয়েছে। তবে একথা সত্য যে, প্রথম পর্যায়ে তিতুমীর প্রজাদের একজোট করেছিলেন ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। কিন্তু দরিদ্র কৃষক প্রজাদের প্রতি নির্মম অত্যাচার দেখে মানব প্রেম ও দেশপ্রেমিকে পরিণত হন।

গুটিকয় কুটিল ঐতিহাসিক তিতুকে ধর্মোন্মাদ ও হিন্দু বিদ্বেষী বলেছেন কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিক তাঁকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও নিরপেক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে উল্লেখ করেছেন-“তিতুমীরের লক্ষ্য ও পথ ছিল ইসলামে পূর্ন বিশ্বাস এবং হিন্দু কৃষকদিগকে সাথে নিয়ে ইংরেজ মদতপুষ্ট জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা। তিতুমীরের আক্রমের লক্ষ্যবস্তু হিন্দুদের পাশাপাশি ধনী মুসলমানও ছিল। তার বক্তৃতা শোনার জন্যে দলে দলে হিন্দু মুসলিম কৃষক জমা হতো।” ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের ভাষায় -” তিতুমীরের এই সংগ্রাম ছিল প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ, যার অভিমুখ ছিল অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবরা ।

লেখক সাতুলিয়া ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার ধর্মশাস্ত্র বিষয়ের শিক্ষক।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর