“দ্য কাশ্মীর ফাইলস”-এ কাশ্মীরের বিকৃত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে

    কলমে- মুহাম্মাদ সাহাবুদ্দিন

বিশেষ প্রতিবেদন, এনবিটিভিঃ সম্প্রতি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল্স’ নামে একটি মুভি প্রকাশ পেয়েছে অনেক বিতর্ককে সঙ্গী করে।  বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত এবং মিঠুন চক্রবর্তী, অনুপম খের, পুনীত, পল্লবী অভিনীত এই ছবি নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ মতের বিতর্কে  তোলপাড় হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি, প্রিন্ট মিডিয়া।

       ফিল্মটি এমন এক সময় প্রকাশ করা হল যখন হিন্দুত্ব বাদীরা ভারতের  সংবিধান, শতশত বছর ধরে লালিত এ দেশের বহুমাত্রিক আদর্শ-সংস্কৃতি বদলে ফেলে এক-মাত্রিক আর্যবর্ণ বাদী হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে সংঘ পরিবার ও তার নিয়ন্ত্রিত বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী। এই পরিকল্পিত হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র এদেশের অন্ততঃ ৮৫ ভাগ মূলনিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিরোধী তাতে কোন সন্দেহ নাই। অতীতে এমনই আর্য বর্ণবাদী রাষ্ট্রে এদেশের মূল নিবাসীদের সীমাহীন বর্বরোচিত অত্যাচারের জীবন ভোগ করতে হয়েছিল। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বর্তমান সরকারের মদদে কাশ্মীর ফাইলস্   তৈরি করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।

       ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস্’ এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কাশ্মীরে পন্ডিতদের উপর নির্যাতন ও  তাদের ‘বিতাড়ন’।  ১৯৯০-এর গোড়ায় এই ঘটনার সূত্রপাত এবং সেই সূত্র ধরে ঘটনাকে টেনে আনা হয়েছে ২০১৬ অবদি, যেখানে সরকার বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। সেই আন্দোলনের সমালোচনা ও সরকারের প্রশংসা করা এই ফিল্মের বিশেষ উদ্দেশ্য। কাশ্মীরি পন্ডিতদের সেই ঘটনাকে নানা মহল নানা ভাবে তুলে ধরে আপন আপন স্বার্থসিদ্ধি করে থাকে। বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত মুভিতে রয়েছে ৬৫০ জন কাশ্মীরি পন্ডিত হত্যার এক অতিরঞ্জিত কাহিনী।

বাস্তবে, সরকারি হিসেবই বলছ, সে সময় এক বিশেষ পরিস্থিতিতে ৮৯ কাশ্মীরি পন্ডিত নিহত হন। এর আগে কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া বহু অবান্ঞ্ছিত ঘটনার প্রতিক্রিয়া বলেছেন অনেকে। সেদিনের সেই অবাঞ্ছিত ঘটনায় ইন্ধন জুগিয়েছিল ১৯৮৭-র নির্বাচন। সে সময় অনেক কাঠ-খড় পোড়ানোর পর নব গঠিত ‘ ইউনাইটেড ফ্রন্ট’ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কাশ্মীরের তৎকালীন পরিস্থিতিতে এই ফ্রন্টের গঠন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ কাশ্মীরিদের মনে অনেক আশা ও উৎসাহ-উদ্দিপনা জাগিয়েছিল। তারা আশা করেছিল এই ফ্রন্টকে শাসন ক্ষমতায় নিয়ে গেলে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া অনেক সমস্যার সুরাহা হবে।

 কিন্তু বাস্তবে সে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় যখন ভোটে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে কংগ্রেসকে  ক্ষমতা পাইয়ে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, কারচুপির নতুন সরকার ফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের উপর অত্যাচার ও তাদের ছেলে ভরতে থাকে। সরকার সেখানেই থেমে থাকেনি, এই সময়ই জম্মু-কাশ্মীরে হঠাৎই নতুন রাজ্যপাল নিযুক্ত হন জগমোহন, তড়িঘড়ি  কৃষ্ণ রাওকে সরিয়ে দিয়ে।

কে এই জগমোহন? তিনি কট্টর হিন্দুত্ববাদী হিসেবেই পরিচিত। ১৯৮৪-তে  আকাশ বিদীর্ণকারী কান্নার আর্তনাদ উপেক্ষা করে দিল্লিতে মুসলিম বস্তির উপর বুলডোজার চালিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের নয়নের মনি হয়ে উঠেছিলেন। কাশ্মীরিদের শায়েস্তা করতে তাঁকেই সেখানে পাঠানো হয়। তিনি জম্মু-কাশ্মীর আরো বেশি করে শিক্ষা দেয়া শুরু করেন। বিধানসভা ভেঙে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ব্যবস্থা করে একক কর্তৃত্ব হাতে তুলে নেন। এরপরই তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় কাশ্মীরিদের উপর অকথ্য নির্যাতনের নতুন ইতিহাস । অনেক কাশ্মীরি হত, নিখোঁজ এবং ধর্ষিতা হয়।

      এসব ঘটনার পর থেকেই কাশ্মীরিদে মধ্যে উগ্রপন্থা বেড়ে যায়। পাকিস্তানপন্থিরা তাদের প্রভাবিত করার  সুযোগ পায় । তারা সেখানকার পন্ডিতদের  উপর আক্রমণ চালায়–যা আগে কখনো দেখা যায় নি। পরবর্তীতেও কাশ্মীরি পন্ডিতদের সঙ্গে সাধারণ কাশ্মীরিদের সম্পর্কের তেমন কোনো অবনতি ঘটতে দেখা যায় নি। সাধারণ কাশ্মীরিরা এটাও মনে করতো, কাশ্মীরি পন্ডিতরা থাকলে তারাও অনেকখানি নিরাপদ থাকতে পারবে। তাই, সেখানকার পন্ডিতরা অনেকে যখন চলে যাচ্ছিল তখন অনেক কাশ্মীরিদের উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়।

       অধিকাংশ কাশ্মীরি এটা মানতে চান না যে শুধু কাশ্মীরিদের নির্যাতনে সেখানকার পন্ডিতরা কাশ্মীর ছেড়েছিলেন । তারা মনে করেন,  কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপত্যকা ছেড়ে যেতে প্ররোচিত করা হয়। প্রশাসনিক মদদে সাহায্য সহযোগিতাও করা হয় । সে সময়  এমন ঘোষণাও করা হয়, চাকুরিজীবী পন্ডিতরা যদি এলাকা ছেড়ে যায় তবে তাদের বেতন দেয়া বন্ধ করা হবে না। এতে অনেক প্রতিষ্ঠিত কাশ্মীরি পন্ডিতরা কাশ্মীর ছেড়ে  যেতে উৎসাহিত হয়, তার প্রভাব অন্যদের উপরও পড়ে।

      অনেক কাশ্মীরি পন্ডিতদের অভিযোগ, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির শিকার হয়েছেন । নব্বইয়ের গোড়ায় যখন কাশ্মীরি পন্ডিতরা উপত্যকা ছাড়ে তখন কেন্দ্রে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং সরকার। বিজেপি তার জোটের অন্যতম শরিক। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই তারা তাদের ৮৫ জন সাংসদ থাকা সত্ত্বেও সেই ঘটনায় সরকারের উপর কোন চাপ সৃষ্টি করে নি, সরকার বা মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করা তো দূরের কথা। এমন পরিস্থিতিতেই জগমোহন সিং-কে রাজ্যপাল নিযুক্ত করা হয়, তিনিও পন্ডিতদের কাশ্মীর ছেড়ে যাওয়া আটকাতে তেমন কোন প্রচেষ্টা নেননি বলেই অনেকের অভিযোগ। এই অভিযোগকরীদের মধ্যে বিশেষভাবে একাধিক কাশ্মীরি পন্ডিতদের সংগঠনও রয়েছে।

বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার মূল্যায়নও অনেকটা একই রকম যে কাশ্মীরি পন্ডিতদের মনে আতঙ্কের ভাব সৃষ্টি করা হয়। রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাই কমিশনারের দপ্তরও একই রকম মত পোষণ করে তাদের রিপোর্টে।

       কাশ্মীরি পন্ডিতদের অনেকের মতে তাদের নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দ্য কাশ্মীর ফাইলস্-এ রবি খান্নাকে নিয়ে কিছু দৃশ্য দেখানো হয়েছে। এই রবি খান্না বায়ু সেনার শহীদ স্কোয়ার্ডন লিডার ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর অভিযোগ, তাঁর মত না নিয়েই এটা করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর পরিবার এই মুভির উদ্দেশ্য বিষয়ে একমত নয়। কাশ্মীরি পন্ডিতদের সংগঠন কেপিএসএস অভিযোগ করে আসছে, তাদের নিয়ে নানা কেচ্ছা তৈরি করা হচ্ছে টিভির পর্দায়। তারা তাদের নিয়ে টিভিতে বিতর্ক বন্ধ করার আহ্বান জানান।

      কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপর অত্যাচারের ঘটনা যে অনেকটাই অতিরঞ্জিত তা নানা পরিসংখ্যান থেকেই বুঝা যায় । একটি সরকারি পরিসংখ্যান মতে মোট নিহতের সংখ্যা–২১৯। ‘পন্ডিত হিন্দু ওয়েলেয়ার সোসাইটি’র সভাপতি মতিলাল ভট্ট পেশকৃত তথ্য এটি। এটি একটি সরকার স্বীকৃত তথ্যও। নব্বইয়ের গোড়ায় জঙ্গিদের হাতে কাশ্মীরি পন্ডিতদের নিহতের সংখ্যা ৮৯, যদিও ফিল্ম মুভিটিতে ৬৫০ দেখানো হয়েছে।

ঐ সময়ে জঙ্গিদের হাতে কাশ্মীরি মুসলমান মারা গেছে কয়েকগুণ বেশি– ১৭২৪ । সুতরাং ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে যে কাশ্মীরি পন্ডিতদের মারা হয়নি তা এই পরিসংখ্যান থেকেই বুঝা যায়। কিন্তু  মুভিতে এই  ধর্মীয় বিদ্বেষকেই প্রকট ভাবে তুলে ধরা হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণে এবং তা গোটা ভারতে পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বিরোধী ঘৃণা-বিদ্বেষের মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।  এ কারণেই মুভিটি দেশের স্বার্থ বিরোধী ও আপত্তিজনক। অথচ সরকার একেই নানা ভাবে মদদ দিয়ে চলেছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যে একে করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

কাশ্মীরি পন্ডিতদের নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাই ঘটুক তা নিন্দনীয়। পাশাপাশি সাধারণ কাশ্মীরিদের উপর ঘটা অত্যাচারের ঘটনাও নিন্দনীয়।এর অনেক লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে। কয়েক হাজার যুবক আজও নিখোঁজ হয়ে রয়েছে। অনেক নারীর এখনও তাদের নিখোঁজ স্বামীদের পথ চেয়ে দিন কাটছে। এরা নিজেদের বিধবা পরিচয় দিতে না পেরে ‘হাফ উইডো’ বা অর্ধ বিধবা পরিচয় নিয়ে দিন গুজরান করছে।

সেখানে অসংখ্য নারী নির্মম ধর্ষিতার শিকার হয়ে কলঙ্কময় জীবনযাপন করছে । ১৯৯১ এর ২৩ ফেব্রুয়ারির কালো রাত্রিতে কুপওয়ারা জেলার কুনান পোশপোরা গ্রামে তল্লাশির নামে অসংখ্য নারিকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করা হয় । কাশ্মীরে  ২৩ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ দিবস পালন করা হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা কাশ্মীরি নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে খুন করেছে এমন ঘটনাও রয়েছে। একটি মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে প্রকাশ, ১৯৯২ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা ৮৮২ জন মহিলা ধর্ষিতা হয়। জানা গেছে, এতে নিরাপত্তা বাহিনীর ১৫০-এরও বেশি শীর্ষ কর্তারা জড়িত ছিল । ‘কমিটি ফর ইনিসিয়েটিভ ইন কাশ্মীর’ তদন্তে গিয়ে ধর্ষণের অনেক লোমহর্ষক তথ্য জানতে পেরেছে ।  এসমস্ত ঘটনাকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে একপেশে ও অতিরঞ্জিতভাবে শুধুমাত্র কাশ্মীরি পন্ডিতদের  নিয়ে মুভি তৈরি করা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কাজ হতে পারে না। এটি উদ্দেশ্য- প্রণোদিত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কান্ড ছাড়া আর কিছু বলা যায় না  

          দেশ স্বাধীন হবার দুমাসের মধ্যেই মুসলিম সংখ্যাগরীষ্ঠ জম্মুতে পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়। উদ্দেশ্য, মুসলিমদের সংখ্যা কমিয়ে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। সেই কারণে ৬০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু অজ  সংখ্যালঘু মুসলিম অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপত্যকা ত্যাগ নি:সন্দেহে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, কিন্তু কাশ্মীরিদেরই অভিযোগ, তাদের উপত্যকা ত্যাগ ছিল সরকারি প্ররোচনা ও ব্যবস্থাপনায়, আর জম্মুতে মুসলিম উচ্ছেদ হয়েছে পরিকল্পিত গণহত্যার মাধ্যমে, যাতে ফ্যাসিবাদী আরএসএস নিজেদের  যুক্ত করেছিল বলে অভিযোগ।

      কাশ্মীরি পন্ডিতদের নিয়ে মুভি তৈরি এই প্রথম ঘটনা নয়। আগেও হয়েছে, এবং তা হয়েছে কাশ্মীরি পন্ডিতদের হাত ধরেই। তাতে কিন্তু ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস্’-এর মত দায়িত্বজ্ঞানহীন একপেশে কাহিনী তুলে ধরা হয় নি। এমনই একটি ফিল্ম ‘দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ কাশ্মীরি পন্ডিত’। সেখানে ভাল-খারাব উভয় দিকই তুলে ধরা হয়েছে কোন পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই। সেটি প্রকাশের আগে হিন্দুত্ববাদীরা কোন আপত্তি করে নি; কারণ তারা ধরেই নিয়েছিল এতে হিন্দুদের তাতানোর উপাদান থাকবে।

কিন্তু প্রকাশের পর যখন তারা দেখল তেমন কিছু নেই, তারপরই তারা বিক্ষোভ দেখাতে নেমে পড়ে  বন্ধ করতে। আর আজ তারাই পক্ষপাতমূলক ও একপেশে কাশ্মীর ফাইলস্  নিয়ে জোর প্রচারে মেতেছে ভারতীয় সমাজ জীবনকে হিংসা-বিদ্বেষে ভরে তুলতে। স্বভাবিক ভাবেই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন–জম্মু, নেলি, গুজরাট, মোরাদাবাদ, ভাগলপুর, মুজাফফরনগর নিয়েও কি ফিল্ম তৈরি করতে রাজি আছেন বিবেক অগ্নিহোত্রীরা?

Latest articles

Related articles