আরবি-ফারসি বাদ দিলে বাংলা ভাষা হয়ে যাবে একেবারে “কাটখোট্টা”

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

বহুরুপি ভাষা।
বহুরুপি ভাষা।

সন্ধেবেলা আরামকেদারায় বসে খবরের কাগজে নজর বোলাচ্ছিলাম। এমন সময় সদর দরজা থেকে জোরালো আওয়াজ এলো, কলমচি বাবু, বাড়ি আছো নাকি?

জবাবে বললাম, হ্যাঁ, মামা, আসুন।

অন্দরমহল থেকে চা পাঠানো হলো। আয়েশ করে চা-নাশতা খেতে খেতে জমে উঠল দুজনের আসর। কথায় কথায় বললাম, আচ্ছা, মামা, আপনি যে ওকালতি পেশার সঙ্গে যুক্ত, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক আরবি-ফারসি শব্দ। জানেন তো?

তাই নাকি ! যেমন?

আদালত দিয়ে শুরু করি?

মানে?

মানে ‘আদালত’ আরবি। ‘শুরু’ও আরবি।

আদালত আরবি, জানতাম। কিন্তু, শুরুটাও আরবি?

জি হ্যাঁ। তারপর ধরুন, আপনি উকিল। ওকালতি আপনার পেশা। এখানে ‘উকিল’, ‘ওকালতি’ আরবি। আর ‘পেশা’টা ফারসি।

জানতাম না তো !

তারপর দেখুন, ‘মামলা’, ‘মোকদ্দমা’ দুটোই আরবি। এতে যারা আপনাদের সাহায্য নেয়, তাদের আপনারা বলেন মক্কেল। এই ‘মক্কেল’ও আরবি। ‘হাকিম’, ‘হুকুম’, ‘এজাহার’, ‘বয়ান’, ‘ফরমান’, ‘ফয়সালা’ এমনকি বিচারপতির ‘রায়’ পর্যন্ত আরবি। আচ্ছা, আসামি শব্দটা কোন্ ভাষা থেকে এসেছে বলুন তো?

আসাম থেকে?

নাহ্। ‘আসামি’ আরবি। এই আসামি বা সাক্ষীদের আপনারা তো জেরা বা সওয়াল করেন, ‘জেরা’ আর ‘সওয়াল’ও আরবি।

আজব ব্যাপার তো !

‘আজব’টাও আরবি। আপনি যে ভিতরে আসার আগে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে, ‘কলমচি বাবু, বাড়ি আছো নাকি’ বলে আওয়াজ দিয়েছিলেন। এখানে ‘আওয়াজ’ ফারসি। ‘সদর’ আরবি। ‘দরজা’ ফারসি। কলমচির ‘কলম’ আরবি, ‘চি’ তুর্কি। আর ‘বাবু’ হলো ফারসি।

বেশ আজব ব্যাপার তো !

এই ‘বেশ’টা ফারসি। ‘আজিব’ আরবি। আর আমি জবাব দিয়েছিলাম, হ্যাঁ মামা, আসুন। এখানে ‘জবাব’ আরবি, ‘মামা’ ফারসি। তারপর, আপনি এসে দেখলেন যে, আমি আরামকেদারায় বসে খবরকাগজে নজর বোলাচ্ছিলাম। এখানে ‘আরাম’ ও ‘কেদারা’ ফারসি এবং ‘খবর’, ‘কাগজ’ ও ‘নজর’ আরবি।

তার মানে, আমরা রোজকার জীবনে যেসব কথা বলি, বেশিরভাগই আরবি, ফারসি?

আলবত। এই ‘আলবত’টাও আরবি। এক্ষুনি আপনি যে বললেন, রোজকার জীবনে… বেশিরভাগই… এখানে ‘রোজকার’ ফারসি, বেশিভাগের ‘বেশি’টা ফারসি।

কী মুশকিল ! এতদিন জানতাম না তো !

‘মুশকিল’ আরবি হলেও শুধু শুধু মুশকিল হবে কেন ! একটু অভিধান ঘাঁটলেই মুশকিল আসান হয়ে যাবে। তখন জানতে পারবেন ‘আসান’ও আরবি। আচ্ছা, মনে করে দেখুন তো, আপনি আসার পর অন্দরমহল থেকে চা-নাশতা পাঠানো হলো। এখানে ‘অন্দর’ ফারসি, ‘মহল’ আরবি। আর নাশতাটা?

নিশ্চয়ই ফারসি।

বিলকুল ঠিকই বলেছেন। ‘নাশতা’ ফারসি। দেখুন এই ‘বিলকুল’ হলো আরবি। আচ্ছা, এরপর আমরা আয়েশ করে নাশতা খেতে খেতে আসর জমিয়ে দিলাম। তাই না?

তাই তো, এর মধ্যেও আরবি-ফারসি আছে নাকি?

অবশ্যই আছে। আরবি-ফারসি বাদ দিলে বাংলা ভাষা সাবলীল গতিতে চলতেই পারবে না যে ! দেখুন আরাম শব্দটা ফারসি, আগেই আমরা জেনেছি। এর জুড়ি যে ‘আয়েশ’, এটা আরবি। আসর জমানোর মধ্যে ‘আসর’ ও জমা দুটোই আরবি। আরবিতে ‘আশর’ মানে দশ। দশজন মিলে যে মজলিস হয়, সেটাই হয়েছে আসর। এক্ষুনি যে ‘মজলিস’ বললাম, এটাও আরবি। ‘জলসা’, ‘মহফিল’ এগুলোও আরবি। অবশ্য কলকাতার বাবুরা মহফিলকে ‘মাইফেল’ (গানবাজনার আসর) বানিয়ে নিয়েছে !

তার মানে, আরবি-ফারসি বাদ দিলে বাংলা অচল হয়ে যাবে !

তা আর বলতে ! এই যে আপনি বললেন, মানে, এই ‘মানে’ শব্দটাও আরবি। বাদ দিলে বললেন তো ! ‘বাদ’ও আরবি। বাদ না বলে ‘বাতিল’ বললে সেটাও আরবি। ‘রদ’ করলেও আরবি। আচ্ছা মামা, আমরা ফের আদালতের রাস্তায় ফিরে যাই চলুন। আসামিকে মাঝে মাঝে তো পুলিশের হেফাজতে রাখতে হয়। তারপর জামিন, খালাস ইত্যাদি থাকে। এখানে ‘হেফাজত’, ‘জামিন’, ‘খালাস’—তিনটিই আরবি। আর হ্যাঁ, ‘ফের’ ও ‘ফিরা’ বা ‘ফেরা’ আরবি এবং ‘রাস্তা’ ফারসি।

‘রাস্তা’য় ‘ফির’তে গেলেও আরবি-ফারসি ! এখন তো দেখছি, আরবি-ফারসি ছাড়া কদম ফেলাই যাবে না !

কী করে যাবে ! ‘কদম’ শব্দটাও তো আরবি। আরেকটা চমকপ্রদ তথ্য শুনুন, আমরা এই যে কথায় কথায় বাঙালি বাংলা বলছি, এর ‘বাংলা’ শব্দটাই তো ফারসি !

সে কী ! জানতাম না তো ! বাংলা শব্দটাও ফারসি। কী আশ্চর্য ! আচ্ছা, বাংলা ভাষায় এত বেশি এবং এমন সব অপরিহার্য আরবি-ফারসি শব্দের স্বচ্ছন্দ ব্যবহার থেকে কী বোঝা যায়?

এটাই বোঝায় যে, বাংলা ভাষার পুষ্টিসাধন ও সৌন্দর্যায়নে বিদেশী ভাষার অনেক বেশি অবদান আছে।

অনেক কিছু জানলাম, বাবা !

‘বাবা’ তুর্কি। ‘কাকা’ ফারসি। কিন্তু আরবির ‘আব্বা’তে আবার আপত্তি ! যাইহোক, আজান হয়ে গেছে। এবার মসজিদে গিয়ে ইশার নামাজটা জামাতে পড়ে আসা যাক, মামা !

হ্যাঁ চলো।

বলছি শুনুন : আমরা, মানে বাংলাভাষীরা, জাতিধর্ম শিক্ষিত নিরক্ষর নির্বিশেষে হাজার হাজার আরবি-ফারসি শব্দ অহরহ ব্যবহার করছি। (‘হাজার’ ফারসি) এগুলো আমাদের মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ ও পুষ্ট করার পাশাপাশি মোলায়েমও করেছে (‘মোলায়েম’ ফারসি)। এসব শব্দকে আমরা বাংলা করেই নিয়েছি। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো (‘আফসোস’ ফারসি), বাংলাভাষীদের মধ্যে ধর্মপরিচয়ে যারা সংখ্যাগুরু তাদের ব্যবহৃত কিছু শব্দ—যেমন : ‘আব্বা’, ‘গোসল’, ‘ফজর’, ‘জোহর’, ‘আজান’, ‘জামাত’, ‘নামাজ’ ইত্যাদি—পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির শিক্ষিত বাঙালির কাছে এখনও বাংলা হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলা অভিধানের কাগজে ঠাঁই পেয়েছে বটে কিন্তু জায়গা পায়নি মনের মগজে (‘জায়গা’ ও ‘মগজ’ ফারসি) ! তাঁদের কাছে এই শব্দগুলো এখনও থেকে গেছে ‘বহিরাগত’ বা ‘বিদেশি’ হয়ে গেছে।

বাংলা ভাষায় এমন হাজারও আরবি-ফারসি-উর্দু ভাসায় মিশ্রণ দেখা মেলে। একসময় ভারতে আরবি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে অফিসিয়াল কাজ কর্মও হত। তার প্রভাব এখন বাংলা ভাষায় প্রকট ভাবে লক্ষ্য করা যায়। তবে এই মিশ্রণ অনেক ক্ষেত্রে ভাষার সৌন্দর্য বহন করে থাকে।

প্রতিটি ভাষার গুরুত্ব কম নয়। কোন জাতীকে বুঝতে গেলে তার ভাষা সাহিত্যর প্রতি একটু মনোনিবেশ করলেই ধরা পড়বে, সেই জাতীর আদ্যপ্রান্ত। আর কোন জাতীকে টিকে থাকতে হলে সেই জাতীর নিজস্ব ভাষাকে রক্ষা করা খুবই গুরুত্ব বহন করে থাকে।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর