এভাবে রফিকে মন থেকে মোছা যাবেনা

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

Mohammed_Rafi_2016_postcard_of_India_crop-flip

~হাফিজুর রহমান, আসোসিয়েট এডিটর, এনবিটিভি

“মুঝকো মেরে বাদ জামানা ঢুডেগা (চলে যাওয়ার পর দুনিয়া আমায় খুঁজবে।)  গায়ক মহম্মদ রফি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ৪২ বছর আগে, ৫৬ বছর বয়স কি যাওয়ার সময়! বিশেষ করে রফির মত  গায়কের? কিন্তু আজ হোক বা কাল সবাইকে যেতে হবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। রফির প্রোগ্রামে দর্শক হয়েছি বার বার। উর্দু  শিখেছি যার গান শুনে তিনি মহম্মাদ রফি। তার গানের সুরে শরীর ভিজিয়ে নিয়েছি বারবার। গানের জাদুতে আচ্ছন্ন আসমূদ্র হিমাচল, মাদকতায় মাতাল দুনিয়া এখনও তাকে ভোলেনি, মনের মধ্যে রেখে দিয়েছে। আজ মহম্মদ রফির ৯৮ তম জন্মদিন। কিন্তু গদি মিডিয়া বা সরকারের কাছে তিনি ব্রাত্য। ১১ ডিসেম্বর দিলীপ কুমার ১০০ তে পা দিলেন। এ বাংলার কোনও কাগজে তার উল্লেখ নেই, এটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত জানিনা। তবে বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে মনে সন্দেহ হয়। শুধু একটি সম্প্রদায়ের বলে কি  বঞ্চনার শিকার ! শিল্পীর পরিচয় শিল্পতে, জাতধর্মের ঊর্ধ্বে ওদের স্থান। কলকাতা সংস্কৃতির পীঠস্থান। ঢাক ঢোল পিটিয়ে ফিল্ম উৎসব হয়ে গেলো। কলকাতার সাংস্কৃতির ধারক বাহকদের কাছে এই প্রতিবেদকের প্রশ্ন, দিলীপ কুমারের ১০০ জন্ম শতবার্ষিকীতে তার ফিল্ম দিয়ে উদ্বোধন করা যেতনা? কেন্দ্রীয় সরকার দিলীপ বা রফিকে ভারতরত্ন দেয়নি তার কারণ বোঝা যায়, কিন্তু কলকাতা তো এসবের ঊর্ধ্বে। এরপরও  কি কলকাতাকে  আমাদের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলবো? কিশোর কুমার ও আর ডি র্বমন আমাদেরও প্রিয় কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি ওদের নিয়ে লেখা হয় কিন্তু রফি ব্রাত্য কেনো? 

একপেশে নয় ! অভিমানও নয় লিখতে বাধ্য হচ্ছি, অপ্রিয় সত্যি আপনাদের সামনে আনতে। রফি আমাদের ছেড়ে গেছেন ৪২ বছর আগে, তাও তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মনের মধ্যে। রফি মুগ্ধতার রেশ মেটানো মুশকিল। মুগ্ধ আমিও তাই কলকাতার একটি দৈনিকের জন্য গিয়েছিলাম মান্নাদের ভিলেপারলের বাংলো আনন্দম এ, ইন্টারভিউ নিতে। কথা বলছিলাম মান্নাদার একতলার ছোট্ট রেওয়াজ ঘরে বসে। রফি প্রসঙ্গ উঠলে মান্নাদা চোখ বুজে  নীরব। তারপর বললেন ” জীবনে এরকম গায়ক আমার চোখে পড়েনি। লতা-আশা-কিশোর কে মনে রেখে বলছি রফির সঙ্গে গান করতে হলে ভয়ে ভয়ে থাকতাম, হাজার চেষ্টা করেও ওকে ছাপিয়ে যেতে পারিনি। সরস্বতীর বরপুত্র ছিল। আমাকে  অগ্রজের সম্মান দিয়েছে।   শিল্পী হতে গেলে ভালো মানুষ হতে হয়, রফি মানুষ হিসেবে কেমন ছিল  তা গোটা দুনিয়া জানে। ওর সব গানই ভালো, তার মধ্যে বেছে নিতে হলে আমার  প্রিয় হীররনঝাই  মদনমোহনের  সুর এ দুনিয়া এ মহফিল,  আর চিত্রলেখা ফিল্মে রোশনের  সুরে  মন রে তু কাহে না ধীর ধরে …  আহা  কি গান গেয়েছে রফি”মান্নাদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা কার্টার রোডে, সুরকার নওশাদ আলির বাংলো আসিয়ানাতে। মনে ভয় ছিল ইন্টারভিউ হবে কিনা! কারণ ওর ছেলে রাজু নওশাদ জানিয়েছে আব্বার শরীর খারাপ। শরীর খারাপ হলেও কলকাতা থেকে এসেছি মহম্মদ রফির …..মহম্মদ রফির নাম শুনে বুড়ো রিক্লাইনিং চেয়ার থেকে উঠে বসলেন। কাজের লোককে চা আনার ফরমায়েশ করে এদিক ওদিক চেয়ে আমার কাছে সিগারেট চাইলেন। শ্বাসকষ্ট ভুগছেন, ধূমপান বারণ তাই আবদার। স্মোক করিনা শুনে  হয়ত বিশ্বাস  হলনা, কটমট করে চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। মনে হলো ইন্টারভিউ এর বারোটা বাজলো। হাজার হলেও লখনউ এর মানুষ নওশাদ। ওখানের তেহজিব বাঁচিয়ে দিল। প্রিয় গায়ক সম্পর্কে বলতে গিয়ে  শের শোনালেন “কহতা হ্যায় কই দিল গয়া, দিলবর চলা গয়া, লেকিন যো সাচ বাত হ্যায় কহতা নেহি কোই, দুনিয়াসে মৌসিকি কা পয়ম্বর চলা গয়া। (কেউ হারিয়েছি মন,কেউ হারিয়েছে প্রেয়সী, কিন্তু যে কথা সবাই লুকোয় সে অপ্রিয় সত্যি হলো  গানের বাদশা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।) এর মধ্যে চা এলো সঙ্গে ছেলে রাজু নওশাদ। 

রফি ম্যানশন, মুম্বাই

ডাক্তারের নির্দেশ বেশি কথা বলা বারণ শোনার পর ইচ্ছে না থাকলেও উঠতে হল। কানে ভাসছিল প্রবাদপ্রতিম এই সুরকারের কথা “লোকে বলে রফির উত্থানের পেছনে আমার হাত আছে সেটা সত্যি, পাশাপাশি এটাও সত্যি রফি আমার সুরে গান গেয়ে আমাকেও বিখ্যাত করেছে। জীবনে ওর মত  গায়ক দেখিনি, আর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখব বলে মনে হয়না”।  মালাবার হিলসে শাম্মীর আকাশ নীল বাংলো। নাম ব্লু হেভেন। শাম্মি অসুস্থ,  কিডনি খারাপ। সদ্য ডায়ালিসিস করিয়ে এসেছেন। অ্যাপয়ণমেন্ট ছাড়া এসেছি। মুশকিল আসান হয়ে এলেন মিকি কাপুর। শাম্মীর ছেলে। মিকির সৌজন্যে শাম্মীর কাছে, হুইলচেয়ারে বসা জংলির ইয়াহু নায়ককে দেখে মন খারাপ হলো। কলকাতা থেকে মহম্মদ রফির খবর নিতে এসেছি শুনে খুশি হলেন একদা পর্দা কাঁপানো নায়ক শাম্মি। উই আর মেড ফর ইচ আদার। মুখে না বললেও রফি বুঝতেন আমি কি চাই। কাশ্মীর কি কলি ফিলমের গান তারিফ করে ক্যা উসকি বার বার ঘুরে ফিরে আসছিল। মিউজিক ডিরেক্টর ও পি নাইয়ারের মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলছে। রফি চুপ করে দেখছিল। তারপর কিছু না বলে হারমোনিয়াম নিয়ে গুনগুন করতে করতে গিয়ে তারিফ শব্দটি নিয়ে জাগলারী শুরু করল। মুহুর্তের মধ্যে সুরের ম্যাজিকে মন্ত্রমুগ্ধ আমরা সবাই। একগাল হেসে ও পি সঙ্গে  গান রেকর্ড করলো। একবার আমি বিদেশে, স্টুডিও বুকড রেকর্ড না করলেই নয়। মিউজিক ডিরেক্টর ও পি নাইয়ার, গায়ক রফি। আমার অবর্তমানে গান রেকর্ড হলো। মনে আশঙ্কা নিয়ে স্টুডিওতে এসে দেখি আমি যা চাই তার চেয়ে বেশি পেয়েছি। আমাকে অবাক দেখে রফি হাসি মুখে জানালো  তুই কোথায় কি হরকত করবি আমি জানি। এতদিন তোর সঙ্গে আছি, তোর শরারতের কথা ভেবে গেয়েছি। শাম্মি কাপুর বলতে লোকে পাগল কিন্তু শাম্মির  সাফল্যের পেছনে মহম্মদ রফির অবদান ভুললে চলবেনা। “সোনু, জাভেদ বা  সাউথের তরুণ সৌরভ কিষণ রফির গান গাইছে। চলে যাওয়ার চার দশক পরেও  লোকে এখনও মহম্মদ রফি নামের জাদুগরি আওয়াজে আচ্ছন্ন।। খবরের কাগজে উল্লেখ না করে বা ভারতরত্ন না দিলেও এভাবে মহম্মদ রফিকে মন থেকে মোছা যাবেনা।  মুছে ফেলা অসম্ভব মোহাম্মদ রফির মত প্রতিভা একটাই জন্মায় তার বিকল্প হয়না। লেখা শেষ করছি  একটি ঘটনা দিয়ে। দিল্লির এক ইংলিশ উইকলির জন্য জগজিৎ সিং এর ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম। কলামন্দিরে প্রোগ্রাম শেষে গাড়িতে ফিরছিলেন জগজিৎ চিত্রা সঙ্গে আমি। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বন্ধুর বাড়িতে ডিনার ছিল। ইন্টারভিউ়ের শেষে রফি সম্পর্কে জানতে চাইলে একটি শের শুনিয়েছিলেন জগজিৎ সিং। “কিসিকো ভি উসকে কদ ক গুমা না থাও আসমা থি মগর শর জমিপে গাড়া থা” (আসমানের উচ্ছতা যার,  নজর জমিনে তার, অহংকার যাকে স্পর্শ করতে পারেনি।) অগ্রজের প্রতি অনুজ শিল্পীর স্রদ্ধা চুইয়ে পড়ছে শেরটি  থেকে।এরপর আর কোনো কথা হবেনা।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর