Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on email

দুয়ারে নিউ ইয়ার ও রঘুরাম

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল গান্ধীর সঙ্গে প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন
ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল গান্ধীর সঙ্গে প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন

~মুদাসসির নিয়াজ

আর মাত্র এক সপ্তাহ। তারপর শীতবুড়ির লাঠি ধরে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে দুয়ারে হাজির হবে হ্যাপি নিউ ইয়ার। ব্যাস, আর কোনো চিন্তা নয়। ২০২৩ সব মুশকিলকে আসান করে দেবে। বদলে যাবে ক্যালেন্ডার। কালের অমোঘ নিয়মে ২০২২ এর পতনে পত্তন হবে ২০২৩ এর।

কিন্তু নতুন বছরেই রাজনেতাদের অগ্নিপরীক্ষা। ২০২৩ সালে রাজস্থান, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজোরামে বিধানসভা ভোট। 23 এই জম্মু-কাশ্মীরেও ভোট হতে পারে। অর্থাৎ ২৩ এর সেমিফাইনাল ম্যাচগুলো ২৪ এর ভবিষ্যতবাণী করে দেবে। ২০২৩ এর ফলাফল বিজেপির পক্ষে খুব একটা স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে হয় না। কেননা উক্ত রাজ্যগুলির মধ্যে ৬টিতে আগের নির্বাচনে বিজেপি ভালো ফল করতে পারেনি। রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসের সরকার রয়েছে। গত পাঁচ বছর হরেক কিসিমের ছক্কা-পাঞ্জা করেও বিজেপি ওই দুই রাজ্যে সরকার ফেলতে পারেনি।

অন্য দু’টি রাজ্যে অবশ্য বিজেপির মিশন সাকসেসফুল হয়েছিল। মধ্যপ্রদেশে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে ভাঙিয়ে কমলনাথের কংগ্রেস সরকারকে ভেঙে শিবরাজ সিং চৌহানকে মুখ্যমন্ত্রী করে সরকার গড়েছিল বিজেপি। আইন, আদালত, গণতন্ত্র, পার্লামেন্ট ও জনমতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে করোনা মহামারী চলাকালে “অপারেশন লোটাস” চালিয়ে এভাবে ক্ষমতা দখল মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। কর্ণাটকেও বিরোধী দলের সঙ্গে গত নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। তেলেঙ্গানায় তো বিজেপির খাপ খোলার কোনও প্রশ্নই নেই। এই হল ৫ বড় রাজ্যে বিজেপির অবস্থা।

জম্মু-কাশ্মীর প্রসঙ্গেও বলা যায়, সেখানে বিজেপির সরকার গড়া আদৌ সম্ভব নয়। বিজেপির ভোট সেখানে মাত্র ২০-২২ শতাংশ। ৩৭০ ধরা বিলুপ্ত করার পর আরো খইষ্ণু হয়েছে গেরুয়া ভোটব্যাঙ্ক।

এখন আর দেশের দিকে তেমন নজর নেই। এখন ওদের একমাত্র লক্ষ্য ২০২৪ এ জিতে ক্ষমতা পুনর্দখল করা। সেদিকে তাকিয়েই আদবানির উত্তরসূরিরা আদাপানি খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। সম্প্রতি গুজরাত বিধানসভা ভোটের পর ওরা মনে করছে ‘গুজরাত থেকেই শুরু হল ২০২৪ সালে গেরুয়া দেশ গড়ার যাত্রা।’ তাই কীভাবে মোদি সরকারের সব ব্যর্থতাকে ঢাকা দিয়ে নতুন কোনও স্বপ্নের ফেরি করা যায়, তা নিয়ে ব্যস্ত পদ্মাসনে বসে থাকা কর্মকর্তারা।

হিমাচলের পরাজয়কে তাঁরা সেভাবে পাত্তাই দিচ্ছে না। তবে এই পার্বত্য রাজ্যে হারের জন্য কিছুটা শাস্তি পেতে হয়েছে জে পি নাড্ডাকে। দলনায়ক এখন খলনায়ক। তাঁর হাত থেকে বেশ কিছুটা ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যদিও হিমাচলে হারের জন্য সেখানকার ভূমিপুত্র তথা কেন্দ্রীয়মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের কেশাগ্র স্পর্শ করেনি নমো-শাহ। সে যাই হোক, এটা ওদের ঘরেলু মামলা।

এই মুহূর্তে বিজেপির প্রধান সমস্যা হল ইস্যু। ইস্যু খুঁজতে এখন তারা রীতিমতো দিশেহারা। কুমীরের বাচ্চার মতো কোন ইস্যুকে তুলে ধরে সহজে ফেরি করা যায়, তাই নিয়ে চলছে ম্যারাথন বৈঠক। দেশভক্তি, হিন্দু-মুসলিম বিভেদ, সিএএ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড, নাকি ফের মন্দির-মসজিদ? গত ৮ বছরে বিজেপির ঝুলি থেকে সব অ্যাজেন্ডাই বেরিয়ে গেছে। এখন তাদের ভিক্ষের ঝুলি প্রায় শূন্যই বলা যায়। তাই কস্মিনকালেও হবে না জেনেও জুমলাবাজি, জিগির আর চমকে ভর করেই ২৪ এর বৈতরণী পার হবার আশায় বুক বাঁধছে তারা।

বিজেপি জানে, মন্দির দেখিয়ে এখন আর ভোট টানা যাবে না। সিএএ নিয়ে অনেক হম্বিতম্বি করেও তা ব্যুমেরাং হতে পারে। তাই মোদি-শাহরা যতই সিএএ-র জুজু দেখান না কেন, বিজেপি এখনই ওপথে পা বাড়াবে বলে মনে হয় না। তাহলে কী আর একটা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের আবহ তৈরি হবে? আর একটা কার্গিল, পুলওয়ামা, বালাকোট সদৃশ সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের চিত্রনাট্য কি ফের দেশভক্তি জাগিয়ে তুলতে পারে? সে সম্ভবনাও ক্ষীণ।

কারণ, পাকিস্তান এখন এমনিতেই নানা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কলহে পর্যুদস্ত। তাই দুর্বল পাকিস্তানকে দিয়ে এখন আর কিছু সম্ভবপর নয়। তাতে দেশভক্তি জাগবে না। তাই পাকিস্তানকে কাজে লাগিয়ে ভোটের ইস্যু করা যাবে না। এদিকে সীমান্তে চীন যা করছে, সেটাও খুব একটা ভোটের বাক্সে কাজে দেবে বলে মনে হয় না। কারণ, প্রথমত: চিন মুসলিম প্রধান দেশ নয়। তাই হিন্দুত্ববাদীরা কপালে তিলক কেটে গায়ে নামাবলি জড়িয়ে গৌর-নেতাই সেজে নেত্য করবে না। দ্বিতীয়ত: চীনা আগ্রাসনকে বেশি করে তুলে ধরতে গেলে কেন্দ্রের সীমান্ত রক্ষার ব্যর্থতা বা ফাঁকফোঁকর অনেক বেশি প্রকট হয়ে পড়বে। একমাত্র পাকিস্তানের জঙ্গিদের নাশকতামূলক কোনও কাজ ভোটের আগে সংঘটিত হলে তা অনেক বেশি ডিভিডেন্ট দিতে পারে। কিন্তু ইমরান খানকে গাজোয়ারি করে ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তান এখন বি-পাকিস্তানে পরিণত হয়েছে। দেশটি এখন কার্যত আর্থিকভাবে দেউলিয়া এবং রাজনৈতিকভাবে কোমায় চলে গিয়ে আইসিইউতে ভর্তি হয়েছে।

তাই ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচন বিজেপির কাছে কাঁটার মুকুটের মতো। শুধু মোদিজির বহুরূপী মুখ দেখিয়ে ভোটজয়ের কৌশল এখন অতীত। মোদি-ম্যাজিক এখন কার্যত উধাও। তাই বিভিন্ন রাজ্যে একের পর এক বিজেপি খারাপ ফল করে চলেছে। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলিতেও বিজেপির ফল খুবই খারাপ হয়েছে। একসময় যে গেরুয়া অভিযান সারা দেশকে মাতিয়ে দিয়েছিল, তার রং এখন অনেকটাই ফিকে। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে বেঁচে থাকার জন্য ইস্যু খুঁজতে হচ্ছে বিজেপিকে। যতই তারা কংগ্রেসকে নিশ্চিহ্ন করে স্বস্তিতে থাকার ছক করুক না কেন, তেলেঙ্গানা বাদে বাকি রাজ্যে তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু কংগ্রেসই। আর মোদির সঙ্গে টক্কর নিতে কংগ্রেস নিয়ে আসছে তার নতুন সংস্করণ, নতুন মোড়ক ও নতুন মুখ।

অন্যদিকে, এখনও পর্যন্ত বিজেপির সকল শক্তির ভরকেন্দ্র কিন্তু সবেধন নরেন্দ্র মোদি। সেকেন্ড ইন কমান্ড অমিত শাহ। বাকি সব নেতা হলেন নিধিরাম সরদার। স্বাভাবিকভাবেই মোদি-শাহ জুটি অনেকখানি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে, যা ফ্যাসিবাদের নামান্তর। মনে রাখতে হবে অবাধ বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। ইউরোপেও গণতন্ত্রের হাত ধরেই ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল।

এদিকে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রায় পা মেলানোয় কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী মুখ হিসেবে নতুন একটি নাম নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। তিনি হলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। তবে কি রঘুরাম রাজন রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন? তাহলে কি পরিবারতন্ত্রের অপবাদ ঘুচিয়ে নতুন করে ফিনিক্সের মতো বেঁচে উঠতে চাইছে কংগ্রেস? তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে ২৪ এ বিজেপির রামকে কি টেক্কা দিতে পারবেন কংগ্রেসের রঘুরাম? মোদি-শাহদের চোখের বালি রঘুরাম কি আম জনতার চোখের মণি হতে পারবেন? তাঁর হাত ধরে কি দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে? দিল্লির ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতির অলিন্দে এখন রঘুরামকে নিয়ে রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছে।

এই প্রেক্ষিতে মনে পড়ে যাচ্ছে কথিত ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ মনমোহন সিংয়ের কথা। জাতীয় রাজনীতিতে যার আগমন হয়েছিল আশীর্বাদের মতো। কাকতালীয়ভাবে রঘুরাম এবং মনমোহন দুজনেই কিন্তু যশস্বী অর্থনীতিবিদ।

২০০৪ এর সেই ইতিহাস ২০২৪ এ পুনরাবৃত্ত হবে কি না, সে উত্তর পেতে আরো বছর দেড়েক অপেক্ষা করতে হবে।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর থাকাকালে মোদিজির নানা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে ‘ইয়েস স্যার’ বলে মেনে নেননি রঘুরাম। তাঁর মেধা, শিক্ষা ও প্রজ্ঞা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল মোদি সরকারের আর্থিক নীতি দেশকে প্যারালাইজড করে দেবে। মোদিও সেদিন বুঝেছিলেন, নোট বাতিলের মতো কাজ করতে গেলে রাজনকে রিজার্ভ ব্যঙ্কের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে রাখা যাবে না। সে জন্য ইয়েস বস মার্কা গভর্নর চাই। তাই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজনকে। ওই পদে বসানো হল আম্বানিদের জামাই উর্জিত প্যাটেলকে। তার সঙ্গেও মধুচন্দ্রিমা বেশিদিন টিকলো না। তাই প্যাটেলকে বিদায় করে আনা হল শক্তিকান্ত দাশকে। স্বাধীন ভারতে এই প্রথম একজন ইতিহাসে এমে করা লোককে বসানো হল রিজার্ভ ব্যাংকের মাথায়।

এদিকে, পদ থেকে সরে গেলেও রঘুরাম রাজন কিন্তু শিরদাঁড়া সোজা রেখে বারবার বিজেপির আর্থিক নীতির যুক্তিগ্রাহ্য সমালোচনা করে দেখিয়েছেন মোদিজীর কারণে কীভাবে দেশের সাড়ে সর্বনাশ হচ্ছে।

দিল্লি আইআইটি থেকে বিটেক, আমেদাবাদ আইআইএম থেকে এমবিএ। তারপর ম্যাসাচুসেটস থেকে ডক্টরেট। ছিলেন আইএমএফের চিফ ইকনোমিস্ট। মনমোহন সিংয়ের আমলে ছিলেন কেন্দ্র সরকারের চিফ ইকনমিক অ্যাডভাইসর। মনমোহনের আমলেই তিনি হন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর। সেই সুবাদে তিনি দেখেছেন দুই প্রধানমন্ত্রীর কাজই। ফারাকটাও বুঝতে পেরেছেন। মোদির অর্থনীতির বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম সোচ্চার হন। ৫৬ ইঞ্চি না হলেও রাজন এর বুকে যে পাটা আছে, এটা আর নতুন করে প্রমাণ করতে হবে না। তাই শুধু আগামী বছরের বিধানসভা ভোটই নয়, নতুন বছরে বিজেপির পথে কাঁটা হতে পারেন রঘুরাম রাজন। ২৪ এ সেই কাঁটা বিছানো পথেই লড়তে হবে বিজেপিকে। তবে সেই লড়াইয়ে হারলেও বিজেপির মান রক্ষা হবে। অন্তত পচা শামুকে মোদী শাহের পা কাটবে না।

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর