“সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষিত আর প্রকৃতি বিচার”- আলোচনা ও সমালোচনার আলোকে

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

IMG-20210911-WA0003

৯/১১-র দু’দশক পূর্তি ও একটি বই
সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষিত আর প্রকৃতি বিচার

 

সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়

 

৯/১১। সেপ্টেম্বরের এগারো। এই তারিখ বলতেই মনে পড়ে যায় ২০০১এর কথা। বিমান হানার মাধ্যমে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার এই দিন ভেঙে ফেলেছিল কয়েকজন উগ্রপন্থী। আল কায়দার সঙ্গে যুক্ত উনিশজন যুবক চারটে বিমান ছিনতাই করে টুইন টাওয়ারে এই আত্মঘাতী আক্রমণ হেনেছিল। আর সেই সময় থেকেই একটা শব্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। শব্দের নাম সন্ত্রাসবাদ। এমন নয় যে সন্ত্রাসবাদ শব্দটা আগে আমাদের অজানা ছিল। তবে এই সময় থেকে শব্দটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক অন্য মাত্রা অর্জন করল। সেই সময়কার আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ ডাক দিয়েছিলেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের। ঘোষণা করেছিলেন, এই সময়ে যে আমেরিকার পক্ষে নয় সে সন্ত্রাসের পক্ষে। এই ঘটনার পরে দুই দশক অতিক্রান্ত। ঠিক এই সময়েই হাতে এল সন্ত্রাসবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি সংক্রান্ত একটি বই। ‘অ্যান এথিকো-ফিলোজফিক্যাল পারস্পেক্টিভ অব টেররিসম’ শীর্ষক এই বইতে লেখক মহম্মদ সেলিম রেজা মূলত সন্ত্রাসবাদের নৈতিক-দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধান করেছেন।
সেলিম গোড়াতেই বলেছেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই সন্ত্রাসবাদ এবং বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের উত্থান রাজনৈতিক চিন্তকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সত্যি কথা বলতে কী অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের কাজকর্মের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একদল যাকে বলছে সন্ত্রাসবাদী কাজ, অন্যদল তাকেই বলছে স্বাধীনতা সংগ্রাম বা জাতীয় বীরত্বের কাজ। প্রশ্ন হচ্ছে নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রকৃতি বিচারধারার পার্থক্য কী? মূলত এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন সেলিম তাঁর এই ২৩২ পাতার বইতে।
ইতিহাসে সন্ত্রাসের শাসন বলতে প্রথমেই মনে পড়ে ফ্রান্সের কথা। সে-দেশে ১৭৯৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৭৯৪ সালের জুলাই পর্যন্ত চলেছিল এই সন্ত্রাসের শাসন। রাশিয়ায় স্তালিনের সময়কালকে, বিশেষ করে ১৯৩০এর দশককে কেউ কেউ সন্ত্রাসের শাসনকাল হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। এই সবগুলোই হল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাসে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর লড়াইকে সন্ত্রাসবাদের ছাপ দিয়ে দেওয়া হয়। সেলিমের বইটার বৈশিষ্ট্য হল যে তা কোনও সন্ত্রাসকেই এড়িয়ে যায় নি। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং রাষ্ট্রকেন্দ্রিক, দু’ধরনের সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কেই আলোচনা রয়েছে বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে। তার আগে সন্ত্রাসবাদের উৎস খুঁজতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর মতে কর্তৃত্ববাদ আর ক্ষমতালিপ্সা, সন্ত্রাসের মাধ্যমে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রবণতাকে চরিতার্থ করতে চায়। কখনও এমনও হয় যে উদারনৈতিক বিপ্লবী আদর্শ কালের কপোততলে অতিবিপ্লবী সন্ত্রাসের রূপ নেয়। লেখক রুশোর ‘সাধারণের ইচ্ছা’র তত্ত্ব যেমন আলোচনা করেছেন তেমনই আলোচনায় এসেছে মার্কস, লেনিন, ট্রটস্কির তত্ত্ব। পল উইলকিনসন বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের যে তিনটে ধারা চিহ্নিত করেছিলেন তা আলোচনা করেছেন লেখক। এই তিনটি ধারা হল, চিরন্তন নৈরাজ্যবাদ, তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লববাদ এবং হিংসার নয়া বাম তত্ত্ব। ম্যানহেইমের তত্ত্বর কথা বলতে গিয়ে লেখক কল্পরাজ্যবাদী বা ইউটোপিয়ানদের কথা বলেছেন। সন্ত্রাসবাদীরা যে কল্পরাজ্য গড়ে তোলার কথা বলেন তাতে সব কিছুই সরলভাবে দেখা হয়, দুটো ভাগে সেখানে দুনিয়ার মানবসমাজকে ভাগ করে দেওয়া হয়; হয় আমাদের বন্ধু আর না হয় আমাদের শত্রু। একজন মনস্তাত্ত্বিক মন্তব্য করেছিলেন, সন্ত্রাসবাদী ব্যক্তি হল সেই-ই যে এক মানসিক জরুরি অবস্থার মধ্যে বাস করে আর তার ঈপ্সিত দুনিয়ার জন্য সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতেও রাজি থাকে না।
সন্ত্রাসবাদের তত্ত্ব আলোচনাতেই সেলিম, এর উৎস অনুসন্ধানকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। সন্ত্রাসবাদের সূত্র সন্ধান করতে গিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন এর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত। রাজনৈতিক আর মনস্তাত্ত্বিক উৎস অনুসন্ধান করার পাশাপাশি বলেছেন সন্ত্রাসবাদ বিকাশের সমাজতাত্ত্বিক কারণ। কিভাবে বঞ্চনার অনুভূতি, বিশেষ করে অর্থনৈতিক বঞ্চনাজনিত পশ্চাৎপদতা সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয় সে-কথা বলেছেন লেখক। তার সঙ্গে গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে সন্ত্রাসবাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত। জাতি এবং বর্ণবৈষম্যজনিত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা যেমন সন্ত্রাসের জন্মদাতা, তেমনই সেই কারণে নিপীড়িত মানুষও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় বেছে নেয় সন্ত্রাসের পথ, ইতিহাসে এই দু’রকম দৃষ্টান্তই মেলে। আবার নারীবিরোধী হিংসা আধুনিক সন্ত্রাসবাদের পরিচিত রূপ। আফগানিস্তানের চলতি ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে যেসব তথ্য আমরা খবরের কাগজ বা সামাজিক মাধ্যম থেকে পাচ্ছি তাতে নারীর বিরুদ্ধে হিংসা এবং তাঁদের ওপরে নানান বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁদের সন্ত্রস্ত করার ছবি দেখতে পাচ্ছি আমরা। আর ধর্মীয় ভেদাভেদ এবং সাম্প্রদায়িকতা থেকে সন্ত্রাসের হরেক ঘটনা তো ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে যার কথা লেখক বিশদে আলোচনা করেছেন। এই ঘটনাসমূহের মধ্যে উল্লেখিত হয়েছে পবিত্র ভূমি নিয়ে লড়াই, ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ, প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ্যশক্তির সঙ্গে বৌদ্ধদের বিরোধ প্রভৃতি। সন্ত্রাসবাদের সূত্র সন্ধানের এই বিশ্লেষণী অধ্যায়টিই এই বইয়ের মূল সুর।
তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক যে রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত সন্ত্রাসের কথা আলোচনা করেছেন সেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রকাশক্ষেত্র হিসেবে যুদ্ধ, গণহত্যা, নির্যাতন এবং ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হননের কথা তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কখনও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কার্যকর হয় আবার কখনও দেশের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে সেক্ষেত্রেও অন্য শক্তির মদত থাকে। ইতিহাসের কথা বাদ দিয়ে যদি এপ্রসঙ্গে ঘটমান বর্তমানের উদাহরণ দেওয়া হয় তবে পাঠকের পক্ষে তা অনুধাবন করা বোধ হয় আরও সহজ হবে। আফগানিস্তানে তালিবান তাণ্ডবের পেছনে কোন শক্তির মদত কার্যকর রয়েছে তা সচেতন পাঠককে বলা বাহুল্যমাত্র। তুলনায় প্রবল রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তি মানুষের লড়াই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আদর্শতাড়িত। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশিষ্ট ধারা সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন বা বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের পেছনে প্রেরণা ছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের হাত থেকে দেশের শৃঙ্খলমুক্তি।
বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় এক অর্থে দ্বিতীয় অধ্যায়ের আলোচনার পরিপূরক। দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক সন্ত্রাসবাদের সূত্র সন্ধান করেছিলেন আর চতুর্থ অধ্যায়ে কৌশল হিসেবে সন্ত্রাসবাদের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি সাজিয়েছেন। এই বইয়ের বিশেষত্ব হল সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উপস্থাপিত বিভিন্ন যুক্তি-তর্ককে সরল করে অথচ তরল না করে উপস্থিত করা। লেখক কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রসঙ্গক্রমে নিজস্ব মন্তব্য সংযোজন করেছেন, আবার কখনও-বা নিজস্ব মত প্রকাশে বিরত থেকে পাঠককে নিজের মত করে ভাবনাচিন্তা করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
বইয়ের শেষে লেখক মন্তব্য করেছেন যদি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সরকার সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়ার প্রতি একটু সংবেদনশীল হন, যদি তাদের অভাব-অভিযোগের দিকে কান দেন, সমস্যা সমাধানে দৃষ্টি দান করেন তবে হয়তো সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম হ্রাস পেতে পারে। মনে রাখতে হবে সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, দু’ক্ষেত্রেই ব্যয় বরাদ্দ বাড়ে প্রতিরক্ষা (পড়ুন যুদ্ধ) খাতে। সামাজিক খাতের বদলে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ আবার এক নতুন বঞ্চনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। যুদ্ধ আর যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিঘ্নিত হয় মানুষের নিরাপত্তা আর সামগ্রিক উন্নয়ন। মানুষের আশু সমস্যা সমাধান না করে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার জিগির তৈরি করা তো আর এক ধরনের সন্ত্রাস!

অ্যান এথিকো-ফিলোজফিক্যাল পারস্পেক্টিভ অব টেররিসম
মুহম্মদ সেলিম রেজা
উদার আকাশ,
ঘটকপুকুর, ভাঙড়,
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা,
পিন ৭৪৩৫০২।
দ্বিতীয় সংস্করণ ২ মে ২০২১।
মূল্য: ৩০০ টাকা।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর