“দ্য প্যান্ডোরা পেপারস” খবরে কেন? ক্ষতি কার? রইল একনজরে

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

images (6)

এখন খবরের বাজার যা নিয়ে গরম তা হল দ্য প্যান্ডোরা পেপারস। কি এই দ্য প্যান্ডোরা পেপারস? এটাও কি সেই দ্য প্যান্ডোরা বক্সের মত দুঃখ,রাগ,হতাশা দিয়ে ভরা কাল ধোয়া ভর্তি বক্স নাকি আরও মারাত্মক কিছু? হয়তো আরও মারাত্মকই ,কারন দুঃখ এখন প্রতি পদে পদে। সে নিয়ে আর এতো মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে আসুন,এই প্যান্ডোরা পেপারস ব্যাপারটা ঠিক কি সে নিয়ে আলোচনা করা যাক। এবার অনেকেই বলবেন আরে ভাই, যা জানিনা তা নিয়ে অত বুঝে কি হবে? ও বড়লোকদের বড় বড় ব্যাপার তারাই বুঝুক। তাহলে বলবো,আপনি ভুল করছেন। এই বড়লোকগুলো আসলে আমাদের ১২টা বাজিয়ে দিয়েছে। কিভাবে? চলুন…

দ্য প্যান্ডোরা পেপারস, প্রায় ১২ মিলিয়ন ডকুমেন্টের গোপন তথ্য, যে তথ্য সদ্য ফাঁস হয়েছে কিছু ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস দ্বারা । এখানে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের কিছু ধনী ব্যক্তি কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে বিভিন্ন ট্রাস্টের নামে অর্থ পাচার করছে।
১১৭ টি দেশের ৬০০০০ এরও বেশি সাংবাদিক কয়েক সপ্তাহ ধরে ১৪ টি উৎস থেকে সংগৃহীত ফাইলগুলি এই সপ্তাহে প্রকাশ করেছেন । ওয়াশিংটন ডিসির ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) , যারা সারা বিশ্বের ১৪০ টিরও বেশি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন।
দ্য প্যান্ডোরা পেপারস, যুক্তরাজ্যে এই তদন্তের নেতৃত্ব দিয়েছে বিবিসি প্যানোরামা এবং দ্য গার্ডিয়ান সংবাদমাধ্যম ।

ফাঁস হওয়া প্যান্ডোরা পেপারসে কি কি রয়েছে?
প্যান্ডোরা পেপারস লিকের মধ্যে রয়েছে 4.4 মিলিয়ন ডকুমেন্ট, প্রায় তিন মিলিয়ন ইমেজ, এক মিলিয়নেরও বেশি ইমেইল এবং প্রায় অর্ধ মিলিয়ন স্প্রেডশিট।
প্যান্ডোরা পেপারস’ই এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনামে। এই কেলেঙ্কারি তে নাম এসেছে বিভিন্ন দেশের অতি ধনীদের। যাদের মধ্যে পপ স্টার সাকিরা, খেলোয়াড়, বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী, রাষ্ট্র নায়ক সবাই আছে। ৯০ টি দেশের ৩৫ জন রাষ্ট্র নায়ক, যাদের মধ্যে প্রাক্তন এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রধান আছেন। এছাড়াও ৩০০ জনের মত ক্ষমতাশালী সরকারি আধিকারিক, মন্ত্রী, বিচারক, মেয়র, সামরিক কর্তার নাম জড়িয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, এঁদের মধ্যে আছেন ভারতীয় ৩৮০ জন।
পৃথিবীতে এমন কিছু দেশ আছে, যাদের মধ্যে বেশীর ভাগের নামই হয়তো অনেকেই শোনেনি কখনো। যেমন শাময়া, বেলিযে, পানামা , দ্য ব্রিটিশ ভারজিন আইসল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, দুবাই, মোনাকো, সুইজারল্যান্ড, ক্যামান আইসল্যান্ডস ইত্যাদি। এই দেশ গুলোকে ট্যাক্স হ্যাভেন দেশ বলা হয়।

Heaven বা স্বর্গ নয়, এই বানানটা হল Haven, অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয়। কারণ এই দেশ গুলোতে বিদেশীদের কর দিতে হয়না বা দিতে হলেও অতি সামান্যই কর দিতে হয়। শুধু তাই নয় এই দেশ গুলোর আইন অনুযায়ী গোপনীয়তার সুরক্ষা দেওয়া হয়। ফলত বিভিন্ন দেশের ধনীদের কাছে এই দেশ গুলো Haven বা আশ্রয় স্থল থেলে Heaven বা স্বর্গে পরিনত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ধনীরা এই সমস্ত দেশে নিজেদের আত্মীয় বা বিশ্বস্ত লোকদের দিয়ে বিভিন্ন রকম কম্পানি বা ট্রাস্ট খোলান। তার পর হুন্ডি বা বিভিন্ন পদ্ধতিতে জটিল লেনদেনের মাধ্যমে ঐ সমস্ত কম্পানি বা ট্রাস্টের একাউন্টে দেশের কর ফাঁকি দিয়ে টাকা পাচার করে। প্যান্ডোরা পেপারস তদন্তে দেখা গেছে ১৪ টা এমন কম্পানি আছে যাদের কাজই হল ট্যাক্স হ্যাভেন দেশ গুলোতে টাকা পাচারের জন্য বিভিন্ন দেশের ধনীদের সহায়তা করছে। ঐ ধরনের টাকা পাচারে সহায়তা করে তারা দুনিয়াতে ২৯ হাজার অফ সোর কম্পানি আর ট্রাস্ট খুলতে সাহায্য করেছে। ধনীদের সম্পদ পাচারের ফলে তার বোঝা অবশ্যই বইতে হয় দেশের সাধারণ মানুষকে। পেট্রল সহ বিভিন্ন খাতে সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা চাপিয়ে সরকারকে ক্ষতি পূরণ করতে হয়।

‘অফশোর’ বলতে আমরা কি বুঝি?
কারও কারও যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি থাকতে পারে, তবে এটি অন্য দেশে অবস্থিত কোম্পানির একটি চেইনের মাধ্যমে অথবা “অফশোর” এর মালিকানাধীন। অর্থাৎ এই দেশের কোন আকজন মানুষ বিদেশে নিজের কোন পরিছিত মানুষের দ্বারা ১টা কোম্পানি বা ট্রাস্ট খুলে সেখানে টাকা পাচার করে।

এই অফশোর দেশ বা অঞ্চলগুলিতে টাকা পাচারকারিরা কেন সুবিধা পায়?
Free market economy দেশগুলিতে কোম্পানি স্থাপন করা সহজ।
এই সব দেশে এমন আইন রয়েছে যা কোম্পানির মালিকদের চিহ্নিত করা কঠিন করে তোলে।
কম বা কোন কর্পোরেশন ট্যাক্স আছে,সরকারি ট্যাক্স নেই।

ট্যাক্স হেভেন ব্যবহার করা কি অবৈধ?
আইনের ফাঁকফোকর মানুষকে আইনগতভাবে তাদের অর্থ স্থানান্তর বা ট্যাক্স হেভেনে কোম্পানি স্থাপনের মাধ্যমে কিছু কর প্রদান এড়ানোর অনুমতি দেয়, কিন্তু এটি প্রায়ই অনৈতিক হিসাবে দেখা হয়।
এর আবার কিছুক্ষেত্রে বৈধতাও রয়েছে। যেমন, এইসব দেশের কোন মানুষ যদি অর্থ এবং সম্পদ ধরে রাখতে চায়, যেমন অপরাধমূলক আক্রমণ থেকে সুরক্ষা বা অস্থিতিশীল সরকারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য, তবে তা বৈধ অফশোর সম্পদ, এবং তা বেআইনি নয়।

যদিও গোপন অফশোর সম্পদ থাকা অবৈধ নয়, তবে গোপন কোম্পানির একটি জটিল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অর্থ ও সম্পদের পাহারে থেকেও আয় গোপন করা আয়কর ফাঁকি দেওয়ার একটি নিখুঁত উপায় এই অফশোরই। ফ্রী ইকনমির এই সকল দেশকে বারংবার অফশপ্র সম্পদের ফাঁক সম্পর্কে ইকনমিস্টরা সচেতন হতে অনুরোধ করলেও কোন লাভ হয়নি।

অফশোর টাকা লুকানো কত সহজ?
আপনাকে যা করতে হবে তা হল উচ্চ স্তরের গোপনীয়তা সহ একটি দেশএর অধীনে একটি কোম্পানি স্থাপন করা। এটি এমন একটি সংস্থা যা কেবল নামে বিদ্যমান, যার কোনও কর্মী বা অফিস নেই। যদিও তাতে আপনার টাকা লাগবে,তবে তা ১টা কোম্পানি চালানর থেকে অনেক কম খরচ। এরপর যেসব বিশেষজ্ঞ সংস্থাগুলি রয়েছে, আপনি তাদের নিজের কোম্পানি স্থাপন ও পরিচালনার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে দিন। এই সংস্থাগুলির কাছে অধিকার আছে,এরা পেইড ডিরেক্টরদের একটি ঠিকানা এবং নাম সরবরাহ করতে পারে। ব্যাস,কেল্লাফতে। নাম,ঠিকানাই তো আপনার ন,তাহলে কম্পানির স্ক্যাম কি করে আপনার হয়? কার ব্যবসা, পিছনে কারা রয়েছে তার কোনও চিহ্নই নেই।

অফশোরে কত টাকা লুকানো আছে?
এটা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব, কিন্তু আই সি আই জে অনুসারে, অনুমান প্রায় $ 5.6 ট্রিলিয়ন থেকে $ 32 ট্রিলিয়ন পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে যে ট্যাক্স হেভেন ব্যবহারের জন্য বিশ্বব্যাপী সরকারকে প্রতিবছর ৬০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত কর দিতে হয়।

মুকেশ আম্বানির ছোট ভাই অনিল আম্বানি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ৩টি চীনা সরকারি ব্যাঙ্কের সাথে চলা মামলার প্রেক্ষিতে লন্ডন আদালতে জানিয়েছিলেন যে তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ শূন্য। ৩ মাস পরে লন্ডন আদালত অনিল আম্বানিকে ৭১৬ মিলিয়ন ডলার ফেরৎ দিতে আদেশ দেয়। কিন্তু আম্বানি এই টাকা ফেরত দেয়নি। তিনি জানিয়েছিলেন গোটা দুনিয়ায় তার কোনো সম্পত্তি নেই। নিজেকে দেউলিয়া দেখিয়ে বেশ কিছু সরকারি সুবিধাও নিয়েছেন অনিল আম্বানি। এবার প্যান্ডোরা পেপারস থেকে জানা যাচ্ছে যে এ হ্যান দেউলিয়া আম্বানি ১৮ টি অফসোর কম্পানির মালিক হয়ে বসে আছেন। প্যান্ডোরা পেপারসে নাম আছে নিরব মোদি, সচিন তেন্দুলকর সহ আরো অনেকের।

জর্ডনের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লার নাম এসেছে কেলেঙ্কারিতে, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে তিনি ১০০ মিলিয়ন ডলারের গোপন সম্পত্তি রেখেছেন বিদেশে।  তদন্তে নাম উঠে এসেছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘনিষ্ঠদেরও। বরিস, পুতিন সহ বিভিন্ন অভিযুক্তরা অভিযোগকে অস্বীকার করে উডিয়ে দিলেও কেনিয়ার রাষ্ট্রপতি উহুরু কেনয়াত্তার ঘনিষ্টদের নাম কেলেঙ্কারিতে জরাবার পরে, রাষ্ট্রপতি এই তদন্ত কে স্বাগত জানিয়েছেন। বলেছেন এই তদন্ত আর্থিক লেন দেনে স্বচ্ছতা আনতে ও উন্নতি করতে সাহায্য করবে। পাকিস্তানে ইমরানখানের খানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী মনিস এলাহি সহ আরো অনেকের নাম আসার পরে ইমরান খান টুইট করে প্যান্ডোরা পেপারসকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশ এখনও নীরব। নীরব থাকতে থাকতেই আমরা বোধ হয় মূক হয়ে গিয়েছি। তবে আর নয়। এবার আওয়াজ তোলার সময় হয়েছে।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর