কালচারাল অপ্রেসেন এবং সংখ্যালঘু অধিকার দিবস

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

Screenshot 2022-12-19 221628

~মানসারুল হক

ইতিহাসের বিকৃতি তাঁর প্রতিরোধ প্রতিকার নিয়ে অধ্যাপক রনবীর চক্রবর্তী গত শনিবারে একটি বক্তব্য দিচ্ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের Tequip বিল্ডিং এর সেমিনার রুমে। অসাধারণ বক্তব্য, মুগ্ধতার সঙ্গে পুরোটা গোগ্রাসে গিলেছেন দর্শকরা। আমিও সেই দর্শকদের একজন।

একদম শুরুর দিকে রনবীর স্যার বললেন, কীভাবে শেষ ৮ বছরে ইতিহাস বিকৃতি চলছে, জোর করে মিথ্যা ইতিহাস চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কীভাবে দিল্লির রাস্তাতে সহজ “কাম চাল রাহা হ্যায়” মতো হিন্দির পরিবর্তে অস্মিতার মতো কঠিন শব্দ দিয়ে কালচারাল আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। আমি স্যারের এই কথাগুলোর সাথে সহমত, কিন্তু শুধু এই ৮ বছরে সব পাল্টে গেছে অথবা কেবল নাগপুর সভারকার,গোলওয়ালকার, শ্যামাপ্রসাদ সব পাল্টে দিয়েছে এই ধারণাটিতে ভুলে ভর্তি।

নাগপুরে গোলওয়ালকারের বাঞ্চ অফ থটস লেখার বহু আগে এই বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু রাষ্ট্রের খতিয়ান লেখা হয়েছে। আসছি সেই কথায়, তাঁর আগে একটা কথা বলা ভালো আপনার চারপাশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কোলকাত্তায়া বাঙালির একটা প্রবণতা আপনারা হয়তো সবাই লক্ষ্য করে থাকবেন। সেটা হলো, দিলীপ ঘোষকে ট্রল করে আমরা হিন্দি বেল্টের চেয়ে আলাদা, বা বিফকে ফ্যান্টাসাইজ করে নিজেকে অতিরিক্ত লিবারেল প্রমাণ করার সে কী কাকুতি মিনতি। সাথে এমন একটা ভাব যেনো সবকিছু গোবলয় শেষ করে দিলো, আমরা তো সরস্বতী পূজার পাঞ্জাবি শাড়ি পরে প্রিন্সেপ ঘাটে যাওয়া কালচারাল বাঙালি। অথচ ওদিকে এই বাঙালির (মুসলিম বাঙালি বাদ দিয়ে) হাত ধরে বিজেপি ১৮ টা সিট জিতেছে গত লোকসভায়, বিধানসভায় ৩ থেকে ৭৭ হয়েছে।

পিছনে গেলে আপনি দেখবেন নাগপুর তৈরি হবার বহু আগে এই বাঙলায় বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে চরম মুসলিম বিদ্বেষের জন্ম হচ্ছে। আনন্দমঠ ফকির এবং চুয়ার বিদ্রোহের গঠনের উপরে লেখা একটা উপন্যাস, যে ফকির এবং চুয়ার বিদ্রোহ হয়েছিলো অত্যাচারী শাসক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, অথচ বঙ্কিম আনন্দমঠকে করে তুললেন মুসলিম বিদ্বেষের বাইবেল। তাই অমিত শাহ কলকাতায় এলে কোথাও না গেলেও বঙ্কিমের বাবার মূর্তিতে মাল্যদান করতে ভোলেননা। এক চরম ইসলামোফোবিয়ায় ভর্তি সেই উপন্যাসের বিভিন্ন পাতা অথচ সেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে জোর করে আমার সাহিত্যসম্রাট বানিয়ে দেওয়া হলো। কারা বানালো?

উত্তর, এই কোলকাত্তায়া কালচারাল লিবারেল বাবু বাঙালি সম্প্রদায়। আর আপনাকে আমাকে পাড়ার স্বাধীনতা দিবসের দিনের কুইজের সময়ে সাহিত্যসম্রাট কে? সেটার উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্রের নাম বলতে বাধ্য করা হলো। যা আজও চলছে। এই বাবু বাঙালিরা গোবলয়ের বিজেপির সমর্থকদেরকে ভক্ত বলে কুল সাজে অথচ এরা নিজেরাও ঐ ভক্তদের চেয়ে কম কিছু নয়। আপনি এদের বানানো সাহিত্যসম্রাটকে প্রশ্ন করলেই ঐ গোবলয়ের কনসেপ্টে আপনাকে অনলাইনে লিঞ্চ হতে হবে। অলস বাঙালি বাবুদের দলবেঁধে লিঞ্চ করতে আসতে ল্যাদ লাগে তাই আপনাকে কমেন্টবক্সে লিঞ্চ করা হবে।

বাস্তবে এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও এই সমস্ত ভক্তরা এখনও সেই হিন্দুত্ববাদের ঠেকাদারকে সাহিত্যসম্রাট বানিয়ে রেখেছে। আপনি প্রশ্ন করলেই বাবু ভক্তদের নেমে আসবে আক্রমণ! ট্যাগ দেওয়া হবে আপনাকে  ইসলামিষ্ট, ছাগু, মৌলবাদী ইত্যাদি, পাছে আপনি ভয় পেয়ে আর প্রশ্ন না করেন।

জোর করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আমার নবজাগরণের মহাপুরুষ বানিয়ে দেওয়া হলো, সমাজ সংস্কারক বানিয়ে দেওয়া হলো। কারণ তিনি নাকি বিধবা বিবাহ প্রচলন করেছেন ১৯ শতকে, ছক ভেঙেছেন ব্রাহ্মণ্যবাদের, অথচ বাঙালি মুসলমান সমাজের সমাজ সংস্কারক তো সেই ১৪০০ বছর আগেই এক বিধবা, ব্যবসায়ী, নিজের চেয়ে বয়সে বড়ো মহিলাকে বিবাহ করে একসাথে অনেকগুলো ছক ভেঙেছেন। আর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের বহু আগে থেকেই বাঙালি মুসলমান সমাজে বিধবা বিবাহ চালু ছিলো, তাহলে জোর করে বিদ্যাসাগরকে আমার সমাজ সংস্কারক বানিয়ে দেওয়া হলো কেনো? জোর করে বাঙালির সমাজ সংস্কারক বলা হলো কেনো? কারা বললো? উত্তর হলো, এই বাবু সমাজ। অবশ্যই বিদ্যাসাগর মহাশয় একজন অগাধ পন্ডিত মানুষ ছিলেন কিন্তু তিনি আমার সমাজে বিধবাবিবাহ চালু করেননি, এই সত্যিটা কটা শিক্ষিত মুসলিম,আদিবাসী জোর গলায় বলতে পেরেছে? বাবু সমাজের কাছে সামান্য গ্রহণযোগ্যতা পেতে সত্য বলার সাহসিকতাটুকুও এরা বর্জন করেছে।

তাহলে বোঝা গেলো এই বাবু সমাজ বাঙালি মুসলমানকে কখনও বাঙালি ভাবেনি এবং সেই ভাবনায় রোপিত গাছের ফলস্বরূপ আজ আপনাকে আমাকে, “তুমি মুসলিম! আমি তো বাঙালি ভেবেছিলাম” শুনতে হয়। যার শিকড় অনেক গভীরে।

বাংলার ঘরে ঘরে কী হিন্দু, মুসলিম, পারসিক, জৈন, খ্রিস্টান, আদিবাসী সন্তানদের শিক্ষালাভ শুরু যে বর্ণপরিচয় দিয়ে তাতে রাম আছেন, শ্যাম আছেন,যদু আছেন, সুবোধ বালক গোপাল আছেন, কিন্তু তাতে আমিনা কোথায়? তাতে ফাতিমা কোথায়? তাতে মিনহাজ কোথায়? তাতে জুলফিকার কোথায়? তাতে বিশ্বজিৎ মাহাতো কোথায়?

একটা বাচ্চা তাঁর লেখাপড়া শুরুর শুভ লগ্নে তাঁর পাশের বাড়িতে থাকা হাজার হাজার বছরের প্রতিবেশীকে চিনলোনা জানলোনা। তাঁরপরে আমরা এখন এসে হা হুতাশ করি, সাবিরদা দেরকে কঠোর পরিশ্রম করে “Know Your Neighbor” চালু করতে হয়।

এই শিক্ষিত বাঙালি বাবু সম্প্রদায়ের লিষ্টে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়, আদিবাসী সম্প্রদায় কখনও ছিলোইনা। তারা তখনও ছিলো অচ্ছুৎ আর এখনও তাই। শুধু “ম্লেচ্ছ” পরিবর্তিত হয়ে এখন “ওরা” হয়েছে।

আগামীকাল হয়তো মোহন ভগবত বা তথাগত রায় ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে পণ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করার কথা ঘোষণা করবেন আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বইতে তথাগত রায়কেও সমাজ সংস্কারক মহাপুরুষ বানিয়ে দেওয়া হবে। আর আমি আপনি কবর থেকে চিৎকার করবো, সেই ৭০০ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি মুসলমান সমাজের জন্য পণ নিষিদ্ধ হয়েছে, আমরা মোহরানা দিয়ে বিবাহ করি। আদিবাসীরা আরও জোরে চিৎকার করে বলবে আমাদের তো আরও হাজার বছর আগে থেকেই পণ নিষিদ্ধ, বরঞ্চ কন্যার পিতাকে সম্পদ দিয়ে বিবাহের রীতি চালু আছে।

এই বাবু বাঙালির আমাদের উপরে যে যুগ যুগ ধরে চলে আসা কালচারাল অপ্রেসেন এবং তাঁর সমাধান জিজ্ঞাসা করেছিলাম রনবীর স্যারকে একান্তে, পাশে দু চারজন ছাত্র ছাত্রী ছিলেন। উনি পরিস্কারভাবে কিছু বলেননি, শুধু বললেন সবার দোষত্রুটি আছে।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর