হিন্দু হিন্দুস্থান! ভারতীয় হতে হলে হিন্দু হতে হবে, মত ৬৪% ভারতীয় হিন্দুর; কিসের ইশারা বলছে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এর জরিপে

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

IMG_20210702_170238

আহমাদুল্লাহ লস্কর ;

পাঠকের কলমে :

ভারতের ধর্মীয় বৈচিত্র্য, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, যুগ যুগ ধরে যা ভারতীয়দের গৌরবের কারণ হয়ে আছে তা বর্তমান ভারতবাসীদের অধিকাংশের কাছে এখন গৌরব নয়, লজ্জার বিষয়। ধর্মনিরপেক্ষতা তো এখন এক শ্রেণীর মানুষের কাছে গালিগালাজের সমতুল্য হয়ে উঠেছে। বর্তমান ভারতের সংখ্যাগুরুদের মতে বৈচিত্র্য প্রয়োজনীয় নয়, ভারতীয় হতে হলে হতেই হবে এক হিন্দু সংস্কৃতির অনুসারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় উঠে এসেছে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য। ভারতীয় জনমানসে আজ বিজেপির উথান এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে যে প্রভাব পড়েছে তার ফলে আজ ভারতবাসী সম্প্রীতি সংহতির ভাষা ভুলতে বসেছে। বিজেপির পান্ডাদের মতো আজ হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্থানের তত্ত্বে বিশ্বাস বিশ্বাস করতে শুরু করেছে অধিকাংশ ভারতীয়। হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন থেকে গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর অনুকরণে উগ্র হিন্দু সম্প্রদায়িক সংগঠন তৈরি করে গলওয়ালকার, হেদগেওয়ার, মালব্যদের মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। তার মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধিক প্রভাবশালী সংগঠন বর্তমান কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির লাগামধারী দল আরএসএস। তারা সেই সময় থেকে ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংস করে অভিন্ন ধর্মীয় পরিচিতি তৈরি করতে ভারতীয়দের অন্তঃকরনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বীজ রোপণ করতে শুরু করে। এত দিন সেই ঘৃণার বীজ বিষাক্ত মহীরুহে পরিণত হয়েছে। দিচ্ছে তাদের প্রত্যাশা মতো ফল ও। তাই ধরা পড়ল পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষায়। ফলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণের মনে।

 

গত ২০১৯ সালের শেষ অর্ধ এবং ২০২০ সালের প্রথমার্ধে ভারতে এই সমীক্ষা চালায় বিশ্বখ্যাত মার্কিন এই থিঙ্কট্যাঙ্ক। ‘ভারতের বিশ্বাস : সহিষ্ণুতা এবং বিভাজন’ (Religion in India : Tolerance and Segregation) শীর্ষক জরিপ চালানো হয় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন শ্রেণী এবং ধর্মীয় পরিচয়ের ৩০,০০০ মানুষের ওপর।

এই সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন প্রকৃত ভারতীয় হতে হলে হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির অনুসারী হতেই হবে। ৫৯ শতাংশ ভারতীয় হিন্দু মনে করে ভারতীয় পরিচয়ের সঙ্গে হিন্দি ভাষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আবার ৫১ শতাংশ হিন্দু মনে করে হিন্দু ধর্মীয় রীতিনীতি এবং সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হওয়া এবং হিন্দি ভাষী উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় পরিচয়ের জন্য।

দেশের ৮৩ শতাংশ হিন্দু মনে করেন হিন্দু মহিলাদের অন্য ধর্মে বিশ্বাসী পুরুষদের সঙ্গে বিবাহ হওয়া উচিত না। আবার ৬৯ শতাংশ এদেশীয় হিন্দু মনে করেন হিন্দু পুরুষদের অন্য ধর্মে বিশ্বাসী মহিলাদের সঙ্গে বিবাহ সম্বন্ধ তৈরি করা গ্রহণযোগ্য না। ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে ৭৮ মুসলিম ও মনে করে মুসলিম মহিলাদের ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী পুরুষদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া উচিত না।

পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে রাজনৈতিক প্রশ্নের জবাবে উত্তর এবং মধ্য ভারতের হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির প্রতি তাদের ভরসার কথা প্রকাশ করেছেন। উত্তর এবং মধ্য ভারতের অর্ধেকের বেশি হিন্দু মনে করেন ভারতীয় রাজনীতি হিন্দু ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখা উচিত। সেদিক থেকে তারা ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপিকে রাষ্ট্রপরিচালনার উপযুক্ত শক্তি হিসেবে মনে করেন। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতের হিন্দুদের মাত্র ৫ শতাংশ মনে করেন ভারতের রাজনীতিকে ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দেখা উচিত।

তবে ভারতীয় হিন্দুরা ধর্মীয় বৈচিত্র্য বিরোধী হলেও তারা মনে করেন ধর্মীয় বৈচিত্র্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিচয় ভারতের জন্য অনেক সুবিধার কারণ। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত এই কারণে অনেক সুবিধা লাভ করে থাকে। এমন মত ৬৫ শতাংশ হিন্দুর। বাকিরা মনে করেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভারতের প্রয়োজন নেই।

অন্যদিকে ভারতের শিখদের ১৯ শতাংশ বিজেপিকে সমর্থন করেছেন গত লোকসভা নির্বাচনে। অন্যদিকে কংগ্রেসকে সমর্থন করেছেন প্রায় ৩৩ শতাংশ ভারতীয় শিখ।

তবে ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সমীক্ষা ভারতের সম্প্রীতিপ্রেমী মানুষের মনে গভীর আশঙ্কার উদ্রেগ করেছে। আবার একই কারণে হাসি ফুটবে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী শক্তির মুখে। ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে বিজেপির জমানায়। যার প্রমাণ পাওয়া যায় নিত্যদিন গণপিটুনিতে মুসলিমদের মৃত্যু থেকে। প্রমাণ পাওয়া যায় ধর্ষিতা মুসলিম হলে ধর্ষকের সমর্থনে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির মিছিল থেকে। প্রমাণ পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুসলিমদের মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলা যে কেউ ট্রোলের মুখে পড়লে তার মধ্যে। প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতের বেশিরভাগ টিভি চ্যানেলগুলো খুললে। প্রমাণ আছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের মুসলমানদের ব্যাপারে করা মন্তব্যে। প্রমাণ যে কোনো নির্বাচনে মুসলিম বিদ্বেষের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ বৃদ্ধির মধ্যে ও। সব মিলিয়ে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির লক্ষ্যে যে উপযুক্ত ছাঁচ তৈরি করে ফেলেছেন তা বলাই বাহুল্য। এখন কিভাবে ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং এর রাজনৈতিক রক্ষক ভারতীয় সংবিধান নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে সেটাই এখন দেখার।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর