~চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
ছবির নাম কিসি সে না কহনা। ১৯৮৩ সালে ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন প্রখ্যাত পরিচালক প্রয়াত হৃষিকেশ মুখার্জি। ছবিটির একটি দৃশ্যের ক্লিপিং ট্যুইট করেন মহম্মদ জুবায়ের। তাতে দেখা যায় দিল্লির একটি হোটেলের সাইনবোর্ডে হিন্দিতে লেখা রয়েছে ‘হনুমান হোটেল’। খুঁটিয়ে খেয়াল করলে বোঝা যায় হোটেলটির পূর্বনাম ছিল ‘হানিমুন হোটেল’, যা আবছাভাবে এখনো রয়ে গেছে। এই ক্লিপিংই কাল হয়েছে জুবায়েরের। প্রবল প্রতাপশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অধীনস্থ দিল্লি পুলিশ বলেছে, “হৃষিকেশ মুখার্জির ছবি থেকে ওই হোটেলের ক্লিপটি শেয়ার করে জুবায়ের ঘোরতর অপরাধ করেছেন। তার বিরুদ্ধে পুলিশ ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত এবং শত্রুতা প্রচারের অভিযোগ এনেছে।”
তা জুবায়েরের ‘ঘোরতর অপরাধ’ বুঝতে দিল্লী পুলিশের পাক্কা চার বছর লেগে গেল কেন! অল্ট নিউজ ওয়েবসাইটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোঃ জুবায়ের তথাকথিত অপরাধমূলক ট্যুইটটি করেছেন ২০১৮ সালে। আর তার বিরুদ্ধে এফআইআর করা হলো গত ২০ জুন। আসলে তাকে ডাকা হয়েছিল ভিন্ন কেসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে। তাতে সুবিধা করতে না পেরে সম্পূর্ণ নতুন মামলায় তাকে ফাঁসানো হয়। এই অভিযোগ করেছেন অল্ট নিউজের যৌথ প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা।
জুবায়ের তার ট্যুইটে সাইনবোর্ডের ছবি দিয়ে বলেছেন, “২০১৪ সালের আগে ছিল হানিমুন হোটেল, আর ২০১৪-র পরে হয়ে গেল হনুমান হোটেল!” দিল্লী পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর অরুন কুমার তার এফআইআর-এ বলেছেন, বালাজি কি জয় নামের ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে জনৈক ‘হনুমান ভক্ত’ এই মর্মে অভিযোগ করেছেন যে, ভগবান হনুমানজির হানিমুন করার কথা বলে সরাসরি হিন্দু ধর্মে আঘাত করা হয়েছে, কারণ হনুমানজি তো ব্রহ্মচারী!” বুঝুন ঠেলা! কথার মারপ্যাঁচে অন্যকে ফাঁসাতে চেয়ে নিজের নির্বুদ্ধিতাকে নগ্ন করা ছাড়া কী আর বলা যায় একে! দিল্লী পুলিশের সিনিয়র অফিসার কেপিএস মালহত্রা আবার আরও এককাঠি উপরে। তিনি বলেছেন, জুবায়েরের ২০১৮ সালের ট্যুইটটি ট্যুইটারে ঘৃণমূলক ভাষণের ঝড় তোলে, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ ছিল। তা ঝড় তোলা ট্যুইটারটির ফলোয়ার কত জানেন? জুবায়ের গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পর্যন্ত মাত্র একজন, আর গ্রেফতার হওয়ার পরে কমবেশি বারোশ জন! তাও আবার জুবায়েরের গ্রেফতারি নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রবল সমালোচনা, রাষ্ট্রপুঞ্জের ভর্ৎসনার পর ‘হনুমান ভক্ত’ তার ট্যুইটার একাউন্টটিকেই মুছে দিয়েছেন। তার মানে সেটি একটি ফেক বা ভুয়া অ্যাকাউন্ট ছিল! আর ভুয়া অ্যাকাউন্ট যে অসৎ উদ্দেশ্যে ভুয়া খবর প্রচারের লক্ষ্যে বানানো হয় তা বলাই বাহুল্য।
মহম্মদ জুবায়ের ২০১৭ সাল থেকে তাদের অল্ট নিউজ নামক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ফেক নিউজ বা ভুয়া তথ্য যাচাইয়ের কাজ করছেন। এ ব্যাপারে তাদের খ্যাতি যেমন আন্তর্জাতিক তেমনি ফেক নিউজ প্রচারের ব্যাপারে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কুখ্যাতি অর্জন করেছে সংঘ পরিবারের পারিবারিক আইটি সেল। ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রচারের মাধ্যমে রাজনৈতিক মেরুকরণকে সামাজিক ভিত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে সংঘ পরিবার আঁকড়ে ধরেছে সমাজমাধ্যমকে। বলা হচ্ছে যুগটাই নাকি পোস্ট-ট্রুথের অর্থাৎ সত্য-উত্তর যুগ। সত্য বলেই নাকি কিছু হয় না! এ সেই বিশ্বসভ্যতার চরম শত্রু হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবলসের তত্ত্ব — মিথ্যেকে জোরের সাথে বল, বারবার বল, তাহলেই লোকে এক সময় তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে। সংগঠিত প্রবল প্রচারের দ্বারা মিথ্যেকে সত্যের মোড়কে পরিবেশন করতে পারাটাই কৃতিত্ব, তাতেই সাফল্যের হাসি চওড়া হয়। হিতাহিত চিন্তা নিষ্প্রয়োজন। অহিতই হিত, যদি তা রাজনৈতিক ডিভিডেন্ট দেয়। আইটিওয়ালাদের সত্যবাদিতা অনেকটা মহাভারতের ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মতো। এমনভাবে সত্য বলো যাতে সত্য বলাও হলো আবার সত্যের গলা টিপে হত্যা করাও হলো। ‘অশ্বত্থামা হত, ইতি – গজ।’ বিদ্বেষজীবীদের আইটি সেল এখন একাধারে আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি। অসত্যকে কত উত্তমরূপে পরিবেশন করা যায় তার নান্দনিক কৌশল তাদের করায়ত্ব, আবার বিপুল এই কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য অর্থের বিনিময়ে পর্যাপ্ত পোষ্য পালন এবং নিয়ত সত্যের মোড়কে অসত্য উৎপাদন — যেটা কিনা একটি বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রিতে পর্যবসিত হয়েছে। তাদের এই মিথ্যার বেসাতি ধরে দেওয়াটাই মহম্মদ জুবায়েরের কাজ। তাই হাস্যকর অভিযোগে তিনি আজ কারারুদ্ধ।
আইটি সেলে উৎপাদিত পরিকল্পিত ফেক নিউজ এবং বিকৃত ইতিহাসের প্রচার নিরন্তর মস্তিষ্ক দূষণ ঘটানোর কাজে নিয়োজিত। পাশাপাশি তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেও প্ররোচনা যোগায়। কয়েক বছর আগে বসিরহাটের একটি সাম্প্রদায়িক অঘটনকে সামনে রেখে একটি ভোজপুরি সিনেমার দৃশ্য ভাইরাল করে ‘চোখে আঙুল দিয়ে’ দেখানো হয় ‘হিন্দুরা কত বিপন্ন’! সর্বশেষ গত ২ মে বহরমপুরের জনবহুল এলাকায় প্রকাশ্যে অত্যন্ত নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় এক কলেজ ছাত্রীকে। প্রেম ও প্রত্যাখ্যানের পরিণামে স্বাভাবিক কান্ডজ্ঞান হারিয়ে যিনি এহেন ধিক্কারযোগ্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন তার নাম সুশান্ত চৌধুরী, আর যে মেধাবী ছাত্রীটির জীবনদীপ অকালে নিভে গেছে তিনি হলেন সুতপা চৌধুরী। মর্মান্তিক এই ঘটনায় তথাকথিত লাভ জিহাদের নামগন্ধ ঘুণাক্ষরেও নেই। তা সত্ত্বেও আইটি সেলের ঘৃণা উৎপাদকরা বা তাদের ভাবাদর্শগত নিকট আত্মীয়রা বহরমপুরের বেদনাদায়ক ঘটনাটিকে নিয়ে নোংরা বিদ্বেষ প্রচারে কসুর করেননি। জনৈক রাজীব টুলি ট্যুইট করে বলেছেন, “মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে লাভ জিহাদের ঘটনা। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের তৃতীয় বর্ষের হিন্দু ছাত্রী সুতপা চৌধুরী ধর্মান্তরে সম্মত না হওয়ায় তাকে খুন করা হয়েছে।” এটি আবার রিট্যুইট করেছেন কপিল মিশ্র(নিচে টুইটের ফটোকপি দেওয়া হল)। জলজ্যান্ত মিথ্যাচারের দৃষ্টান্ত হিসেবে এ দুটি ঘটনা উল্লেখ করা হল। এই ধরনের সংগঠিত মিথ্যাচার এদেশে অবিরত ঘটে চলেছে।
উদ্দেশ্যমূলক সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারের ফলও ফলছে দেশজুড়ে। ২০১৬ থেকে ২০২০ এই পাঁচ বছরে এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে ৩৩৯৯টি। গত ৩০ মার্চ লোকসভায় এ তথ্য পেশ করেছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায়। আরও একটি উদ্বেগজনক তথ্য জানাই। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার হল সাংবাদিকদের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এই সংস্থা প্রতিবছর এপ্রিল মাসে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেই রিপোর্ট থেকে জানা যায় বিশ্বের নির্দিষ্ট ১৮০টি দেশের মধ্যে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে কে কোথায় দাঁড়িয়ে। আমাদের দেশে মহামহিম মোদি সরকার যখন তাঁর শাসনের দ্বিতীয়
বার্ষিকী পালন করেছেন তখন অর্থাৎ ২০১৬ সালে ভারত ছিল ১৩৩ নম্বরে। সে সময় প্রতিবেশী বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, এমনকি ‘শত্রু’ পাকিস্তানের অবস্থানও ছিল আমাদের উপরে। পরের বছর (২০১৭) আমাদের দেশ আরো তিন ধাপ নিচে নেমে তালিকায় ১৩৬ নম্বরে চলে যায়। পরবর্তী তিন বছর দু’ধাপ করে নিচে নামে। ২০২০ এবং ২০২১ সালে দাঁড়িয়েছিল ১৪২ নম্বরে। তারপর এবছর এপ্রিল মাসে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী মোদি ভারতের অবনতি এক ধাক্কায় ৮ ধাপ অর্থাৎ এই মুহূর্তে ভারত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০ নম্বরে। হবে নাই বা কেন? গদি মিডিয়ার বাইরে যারাই এখনও স্বাধীন সত্তা বজায় রাখার লড়াই চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধেই পুলিশ, ই ডি, আই টি ইত্যাদি এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ২০২০ সালে অতিমারি করোনাকালে ৫৫ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জামিনে ছাড়া পেয়েছেন, কেউ কেউ এখনও কারারুদ্ধ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম – সিদ্দিক কাপ্পান(আজহিমুখম), আসিফ সুলতান (কাশ্মীর ন্যারেটর), গৌরব বনসল (পাঞ্জাব কেশরি), মিনা কোতোয়াল (মুকনায়ক), মানান দার (পেসিফিক প্রেস) এবং কাশ্মীরওয়ালা পত্রিকার ফাহাদ শা এবং সাজ্জাদ গুল। শাসকের প্রতিহিংসার তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন সাংবাদিক মহম্মদ জুবায়ের।