কোভিড নয় বিশ্বব্যাপী ‘ইসলামফোবিয়া’ সংক্রমনের কারণে চিহ্নিত হয়ে থাকবে ২০২০

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

5046

সাইফুল্লা লস্কর, এনবটিভি :

২০২০ সাল বিগত, এখন চলছে বিগত বছরের চুল চেরা বিশ্লেষণ। এখন চলছে লাভ ক্ষতির হিসেব, পাওয়া ও না পাওয়ার হিসেব। তবে সব থেকে বেশি প্রাপ্তি যোগ ঘটেছে করোনা নামক ভাইরাসটির। যেটা পেরেছিল বহুদিন থেকে চলমান সভ্যতার চাকাকে স্তব্ধ করে দিতে। তবে এই বছরকে চিহ্নিত করা হবে আরো একটি কারণে তা হলো বিশ্বব্যাপী ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলোর সক্রিয়তা এবং ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেন, “সারাবিশ্বে বর্তমানে আমাদের সব থেকে বড় যুদ্ধ covid-19 এর বিরুদ্ধে। কিন্তু এই ভাইরাস এর থেকেও ইসলামোফোবিয়া ভাইরাস অনেক দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে।”

বিগত বছরে কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী এমন এক মহামারীর আগমনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা এই নীল গ্রহ বহু শতাব্দীতে একবার সাক্ষী হয়। বিগত বছরটিতে এই মহামারী ছাড়াও প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সশস্ত্র যুদ্ধ এবং ইসলামফোবিয়া শিরোনাম দখল করেছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের থেকে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে বেশি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল অনেক পশ্চিমা রাষ্ট্রশক্তি সহ প্রাচ্যের দেশসমুহ। কোথাও ইসলামের প্রচার অবরুদ্ধ করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে, আবার কোথাও ইসলামকে সরাসরি আক্রমণ করা হয়েছে রাষ্ট্র নায়কের দ্বারা। কোথাও মুসলিমদের মৃতদেহ অমানবিকভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আবার কোথাও মুসলিমদের বিদেশি প্রমাণের সনদ প্রস্তুত করা হয়েছে। কোথাও মুসলিমদের ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হচ্ছে আবার কোথাও তার পূর্বপ্রস্তুতি চলছে। এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলোর এই বছরের কর্মসূচিগুলো :

ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতির ইসলামকে আক্রমণ :

ইসলাম বিরোধিতায় এই বছর সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছে ফ্রান্সের ইসলাম বিরোধী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো। ম্যাক্রো ইসলামকে আক্রমণকে করে বলেন, এটি একটি সংকটাপন্ন ধর্ম। তিনি তথাকথিত রেডিক্যাল ইসলামের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সেদেশের ইসলামকে বিদেশি প্রভাব মুক্ত করার কথা বলেন। চার্লি হেবদো আবার নবী মুহাম্মদ (সা.) এর বিরুদ্ধে অবমাননাকর কার্টুন ছাপালে পুরো ফ্রান্স জুড়ে তার সমর্থন করা হয়। ম্যাক্রোও সামনে থেকে তার সমর্থন করেন। এই কার্টুন প্রচারকে কেন্দ্র করে এক শরণার্থীর হাতে মৃত্যু হয় এক ফরাসী শিক্ষক স্যামিউয়েল প্যাটির। তাকে শহীদ আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রিয় সম্মানে সম্মানিত করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট। তারপর থেকে তিনি বেশি করে ইসলাম বিরোধিতায় লেগে পড়েন। প্রকাশ্যে ইসলাম বিরোধিতাকে সমর্থন করেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে। সারা বিশ্ব জুড়ে মুসলিমরা বয়কট করা শুরু করে ফরাসি পণ্য। তাতে বহু লোকসান হয় ফরাসি অর্থনীতির। তুরস্ক ফ্রান্সের বিরোধিতায় নিজেদের রাষ্ট্রদূত ফেরত নিয়ে নেয়। তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোগান তাকে আক্রমণ করে বলেন, এখন ইসলাম বিরোধিতাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মাথাদের দ্বারা। তারা ইসলাম বিরোধিতার জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে আশ্রয় নিচ্ছে। এই সময় পশ্চিমা ঘনিষ্ট আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবের রাজারা নিরব থেকে সাহায্য করে ফ্রান্সকে।

ভারতে মোদি সরকারের CAA, কাশ্মীরে অবরোধ এবং করোনার জন্য মুসলিমদের দোষী বানানো :

কাশ্মিরে ২০১৯ এর ৫ ই আগস্ট মোদি সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নিয়ে কাশ্মীরকে খোলা আকাশের নিচেই উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করে। প্রতিবাদ করারও অধিকার দেওয়া হয় নি কাউকে। হাজারো লাখো কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে কাশ্মিরী অর্থনীতির। সেই থেকে বহু কাশ্মিরী নিহত হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে। মিথ্যা সন্ত্রাসবাদী সাজিয়ে ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যা করা হয়েছে বেশ কিছু নিরীহ কাশ্মিরীকে। এই সব অভিযোগে FIR দায়ের করা হয়েছে একজন ক্যাপ্টেন এবং বেশ কিছু পুলিশ ও সেনা জওয়ানের বিরুদ্ধে।

এরই মাঝে মোদি সরকার প্রণয়ন করেছে সংবিধানের মৌলিক মূল্যবোধ বিরোধী বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। যার সঙ্গে ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস এর মেল বন্ধনে তৈরি হতে পারে এমন এক ফাঁদ যা থেকে ভারতের মুসলিমদের বের হওয়া বেশ কষ্টকর বলে মনে করছেন বহু বিশেষজ্ঞ। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সংসদে পাশ হওয়ার পর রাস্তায় বেরিয়ে আসে ভারতের লক্ষ্য কোটি মুসলিম জনতা। কোথাও কোথাও আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। প্রাণ হারায় বহু প্রতিবাদকারী, উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার বাজেয়াপ্ত করে বহু প্রতিবাদকারীর সহায়-সম্পত্তি। অনেকের বিরুদ্ধে লাগানো হয় ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। শুরু হয় শাহীনবাগ এর আন্দোলন। তা সত্ত্বেও মোদি সরকার অনড় এই আইন বাস্তবায়নে। সব কিছুর মাঝে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের হাতই শক্তি করে।

মার্চ মাসে দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়া মারকাজ মসজিদে তাবলীগের ইজতেমাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা তাবলীগ জামাতের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। তখন দেশে ছিল না কোনো লকডাউন বা করোনা বিধি। কিন্তু তারপরেও পরবর্তীতে কিছু তাবলীগ জামাত সদস্যের মধ্যে করোনাভাইরাস এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়ার পর গেরুয়া ব্রিগেড থেকে মোদি ঘনিষ্ঠ গেরুয়া মিডিয়া ভারতে করোনা বিস্তারের জন্য দোষারোপ করা শুরু করে সমগ্র ভারতীয় মুসলিম জাতিকে। গ্রেফতার হন বহু তাবলীগী সদস্য। ব্ল্যাক লিস্টেড করা হয় সমস্ত বিদেশি সদস্যদের। অনেককে গ্রেফতার করে রাখা হয় বহুদিন। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন মন্দিরে এর থেকেও বেশি জমায়েত, অধিক পরিমান করোনা সংগ্রমন এবং রোগীর উপস্থিতির প্রমাণ পেলেও একই প্রবণতা দেখা যায়নি সরকারের তরফে। এই দ্বিচারিতা ভর্ৎসনার স্বীকার হয় এলাহাবাদ হাইকোর্ট, বোম্বে হাইকোর্ট, দিল্লি হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে ও।

অস্ট্রিয়ার ইসলাম বিরোধী আইন বলবৎ :

ভিয়েনায় এক সন্ত্রাসবাদি হামলার পর অস্ট্রিয়া সরকার সে দেশের মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে শুরু করে দমন-পীড়ন। নিয়ে আসা হয় একটিতথাকথিত রাজনৈতিক ইসলাম বিরোধী ড্রাকোনিয়ান আইন। তাতে বলা হয় অস্ট্রিয়াতে রাজনৈতিক ইসলামে বিশ্বাসী সমস্ত মুসলিমদের আইনের সম্মুখীন হতে হবে। অস্ট্রিয়ার চান্সেলার সেবাস্তিয়ান কুর্জ বলেন, আমরা সন্ত্রাসবাদকে সরাসরি পরাস্ত করতে পারব না যতক্ষণ না আমরা সন্ত্রাসবাদের পেছনে মদদদাতা মতাদর্শকে পরাজিত করতে পারব। রাজনৈতিক ইসলাম সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করে। তাই এই রেডিক্যাল ইসলামের বিরুদ্ধে আমাদের মূল লড়াই।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর জবাবে বলেন, আসলে রেডিক্যাল ইসলাম বা রাজনৈতিক ইসলাম বলে কোন কিছু নেই। ইসলাম হলো ইসলাম যার অর্থ শান্তি। কোন কোন রাজনৈতিক নেতা ইসলামকে নিজেদের মতো করে বোঝে এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজের ভাষায় তা ব্যাখ্যা করে।

শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়া :

শ্রীলঙ্কায় বহুদিন থেকে বৌদ্ধ উগ্রবাদী গোষ্ঠী মুসলিমদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদি কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো মসজিদ কখনো মাদ্রাসা আবার কখনো মুসলিমদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু বর্তমানে শ্রীলঙ্কার সরকার এবং সে দেশের বিচার ব্যবস্থা করোনা আক্রান্ত মুসলিম মৃতদেহ পুড়িয়ে দেয়ার স্বপক্ষে আইন প্রণয়ন ও সমর্থন করে। এই আইন রাষ্ট্রসঙ্ঘের দেওয়া নির্দেশিকার বিরুদ্ধে এবং করোনার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া নিয়মাবলীর পরিপন্থী হলেও শ্রীলংকা সরকার তা প্রত্যাহার করেনি।

চীনে উইঘুরদের ওপর অত্যাচার :

চীনের উত্তর-পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের উপর বহুদিন থেকে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট সরকার। তাদের বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি রেখে রাখা হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে দাড়ি রাখায়, টুপি পরায়, মসজিদে নামাজ পড়ায়, রোজা রাখায় এমনকি ইসলামী নাম রাখার ওপরেও। আমেরিকা ব্রিটেন কানাডা সহ বেশকিছু পশ্চিমা দেশ এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও টনক নড়েনি চীনা সরকারের।

বেলজিয়ামে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা :

জুন মাসে বেলজিয়াম সরকার দেশের সমস্ত স্কুল কলেজ এবং ইউনিভারসিটিতে হিজাব পরিধান নিষিদ্ধ করে। এর বিরুদ্ধে বহু ছাত্র-ছাত্রী প্রতিবাদ করেন।

সুইডেন এবং নরওয়েতে কুরআনের অবমাননা :

আগস্ট মাসে সুইডেনে ইসলামবিরোধী মিছিলের আয়োজন করে সেখানকার দক্ষিণ পন্থীদের ডিলেট সদস্যরা। সেখানে কোরআন শরীফ জ্বালানো হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। সেই ঘটনার পরপরই মুসলিম বিশ্বের প্রবল প্রতিবাদকে অপেক্ষা করে নরওয়েতে প্রকাশ্য রাস্তায় পুলিশি নিরাপত্তায় কোরআন শরীফ অবমাননার ব্যবস্থা করা হয়। প্রতাবাদ করতে গিয়ে মারা জন এক মুসলিম।

আরব আমিরাতের ১১ টি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা :

মুসলিম দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার দিক থেকে সব ক্ষেত্রে সৌদি দোসর আরব আমিরাতকে সম্মুখ সারিতে দেখা গিয়েছে। তারা ইসরাইলের সঙ্গে প্রকাশ্যে আমেরিকা এবং গোপনে সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তারপর বাহরাইন, সুদান, মরক্কো সহ বেশি কিছু মুসলিম দেশকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করে। এর পর যারা অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা। সেই অনুসারে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় পাকিস্তান তুরস্ক সহ ১১ টি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে। এছাড়াও তারা কাশ্মিরে মুসলিমদের ওপর মোদির দমন পীড়ন নীতির সমর্থন প্রদান করে এবং মুসলিম হত্যার অভিযোগে বিদ্ধ মোদিকে তাদের দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান প্রদান করে। ভূমধ্যসাগর এবং লিবিয়াতে তুরস্ক এবং লিবিয়ার সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইল গ্রিস এবং ফ্রান্সের পক্ষ নেয় তারা।

এছাড়াও ডেনমার্কে ইমাম এবং মুসলিম পিতা মাতাদের উদ্দেশ্য করে বানানো হয় বিতর্কিত পণ প্রথা বিরোধী আইন যার মূল লক্ষ্য ছিল ইমাম ও মুসলিম পিতামাতাদের হেনস্থা করা। অস্ট্রেলিয়াতে করোনা সংক্রমনের জন্য ডানপন্থী দলের নেতারা মুসলিমদেরকে দায়ী করে। ব্রিটেনের মুসলিমদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হয় একইভাবে। করোনাকালে ব্রিটেনে গত বছরের তুলনায় এ বছর ইসলাম বিরোধী মন্তব্য এবং অনলাইন কনটেন্টের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। আমেরিকাতে আইএসপি ইউ এর গবেষণায় দেখা গিয়েছে আমেরিকার ৬০% মানুষ সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এছাড়াও ৪০ শতাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের শিকার হয়েছেন যেমন চিকিৎসাব্যবস্থা স্কুল এয়ারপোর্ট প্রভৃতি জায়গায়। তাই বলা যায় করোনা ভাইরাসের থেকে ইসলামোফোবিয়া ভাইরাস বিশ্বব্যাপী অনেক দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে সদ্য বিদায় নেওয়া বছরটিতে।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর