স্মরণে মননে ইবনে ইমাম: কাফেলার অন্যতম ঊজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

ইবনে ইমাম
ইবনে ইমাম


~মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস

জীবন ছোটো হয়ে আসছে৷ সাথে সাথে সময় বলে দিচ্ছে কিছু কাজ তোমাকে করতে হবে, এবং তোমাকেই করতে হবে৷ তোমার পরে এ কাজ আর কে করবে তার ঠিকও নেই , ঠিকানাও নেই৷ অতএব, এ কাজ ও এ দায়িত্ব আমি হাতে তুলে নিলাম৷
আবদুল আযীয আল আমান সময়ের আহ্বানও বুঝতেন, সময়ের গুরুত্ব এবং ভাষাও বুঝতেন৷ এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি কাফেলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ সময়ের ভাষা ও বাণীকে কাফেলায় লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেছিলেন৷
কাফেলার সাহিত্যাসরে নিয়মিত অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাইকে আমি চিনতাম কিন্তু সবার সঙ্গে আমার কথা হয়নি৷ প্রবীণদের মধ্যে কবিরুল ইসলাম, মাহমুদল হক, জালালউদ্দিন আহম্মদ , বেগম সুরাইয়া কামাল প্রমুখকে চিনতাম কিন্তু কথাবার্তা হয়নি বললেই চলে৷ তবে, প্রবীণ ইবনে ইমাম, রফিকউল্লাহ সহ এডভোকেট আবদুর রফিক প্রমুখের সঙ্গে রীতিমতো ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল৷ এ মান্নাফ-আবু আতাহারের কথা তো আগেই লিখেছি৷
নবীনদের মধ্যে অনেককেই চিনতাম ঘনিষ্ঠতা না হওয়া সত্ত্বেও৷ মতিউল্লাহর নাম তো করতেই হয়৷ হাসির মল্লিক হুগলি থেকে আসত৷ মোস্তাব আলী নামে এক যুবক হাসনাবাদ থেকে আসত৷ অসাবধানবশত কারো নাম বাদও পড়তে পারে৷ মনে এলে যোগ করে দেবো৷

ইবনে ইমাম কাফেলার ঊজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক৷ নিরহঙ্কার সদাহাস্য আনন্দপ্রিয় মানুষ৷ তিনি যত বলতেন ততই শুনতে ভালো লাগত৷ তাঁর বাগ্ -ভঙ্গী ও লিখনশৈলী ছিল তাঁর একান্ত নিজস্ব৷ তাঁর ‘সরাইখানার যাত্রী’ পড়ার পর তাঁকে ভুলে যাওয়া অত সহজ নয়৷ কাফেলার কল্যাণেই তাঁকে আমরা চিনেছিলাম৷ তাঁর আরো কিছু বই আছে৷ সেগুলি রচনাসমগ্র হয়ে প্রকাশিত হওয়া উচিত৷
তিনি ছিলেন লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করা উচ্চ শিক্ষিত মানুষ৷ একজন কৌতুহলী কিশোরের মতো তাঁকে আমি প্রশ্ন করতুম৷ ‘সরাইখানার যাত্রী’ শুধু পড়িনি, তার বিষয়াদিও তাঁর মুখ থেকে থেকে শুনেছিলুম৷
তিনি ইউরোপের একাধিক দেশ ও তুরস্ক ভ্রমণের কথা বলেছিলেন আমাকে৷ এ প্রসঙ্গে তাঁর স্মরণীয় উক্তি আমার আজও মনে রয়ে গেছে৷ তিনি বলেছিলেন, ঢাকা-কলকাতা-দিল্লির পুরানা মহল্লাগুলো যেমন ঘিঞ্জি বস্তির মতো তেমনি ইউরোপের বড় বড় নগরগুলোর পুরানো মহল্লাগুলিও ওই রকম৷
তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের বর্ণনা শুনে আমি খুব কৌতুক বোধ করেছিলুম৷ আসলে একটা ঘটনা ঘটেছিল৷
ওই সময়ের কিছু কাল আগে আমি একটি তুর্কি ছায়াছবির ইংরেজি ডাবিং দেখেছিলুম৷ ছবিটার নাম ছিল ‘ কনকয়ার টু এ গোল্ডেন সিটি”৷ ওই সিটিটাই ছিল ইস্তাম্বুল৷ অদ্ভুত ব্যাপার হল তাঁর বর্ণনার সঙ্গে এই ছবির বর্ণনা হুবহু মিলে গিয়েছিল৷
কাফেলা-গতির অফিস এক পর্যায়ে কলেজস্ট্রিট মার্কেটের দো’তলা থেকে ১বি জাননগর রোডে চলে এসেছিল৷ ওটা ১৯৮৬ সালের শেষ ও ‘৮৭ সালের দিককার কথা৷ আমান সাহেব আমাকে গতি-কাফেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে নিয়ে ওই অফিসে নিয়মিত করে নেন৷ আমার সহকর্মী হয়েছিল রফিকউল্লাহ সাহেবের দুই ছেলে রবিউল করিম ও ফিরোজ জুলফিকার৷ ওরা দুজনেই বয়সে আমার ছোট ছিল৷ আমাকে দাদা ডাকত৷
জাননগরের কাফেলা-গতি অফিস অনেক বেশি মুক্ত পরিবেশে থাকাতে সাহিত্যসেবী-কবিতাপ্রেমিকরা ইচ্ছামতো যাওয়া-আসা করতে পারতেন৷ প্রবীণ-নবীন সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকত অফিসের দ্বার৷ রবিবাসরীয় সাহিত্যসভা তখন ওখানেই বসত৷
ইবনে ইমাম সাহেব প্রায়ই আসতেন৷ উনি এলে আমার খুব আনন্দ হত৷ তাঁর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু জানতে পারতাম৷
পার্ক সার্কাসের পার্ল রোডে থাকতেন তিনি৷ কথা প্রসঙ্গে জানতে পেরেছিলাম মনস্বী আবু সয়ীদ আইয়ূব ও তিনি একই বিল্ডিংয়ের উপর নিচের ফ্ল্যাটে থাকতেন৷ সেয়দ মুজতবা আলী আইয়ূবের সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে থাকতেন৷ তাঁদের সম্পর্কে অনেক কথা আমি অনেক কথা জানতে পেরেছিলুম৷ সৈয়দ মুজতবা আলী ও আবু সয়ীদ আইয়ূবকে আমি দেখিনি; তাঁদের রচনাবলী পড়েছি৷ তাঁদের সাহিত্য নিয়ে পরে লেখার ইচ্ছা পোষণ করি৷
আমার অগোছালো ছন্নছাড়া জীবনটাকে নিয়ে আজীবন মুসাফিরি জীবন কাটিয়ে এলুম৷ সে বড় দ্বন্দ্বমধুর জীবন৷ এই তিন ব্যক্তির জীবন ছিল আরো দ্বন্দ্বমধুর৷ তাঁদের জীবনবৃক্ষের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে অমূল্য জীবনধারার অশ্রুতপূর্ব কাহিনী৷ কিছু রয়েছে তাঁদের জীবনপত্রে, কিছু রয়েছে তাঁদের রচনায়৷
ইবনে ইমাম সাহেবকে আমি চাচাজী সম্বোধন করে কথা বলতুম৷ আমার প্রতি তাঁর আচরণ ছিল অত্যন্ত স্নেহমধুর৷ তাঁর মৌখিক ভাষা ও বাকরীতির একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল৷ উচ্চশিক্ষিত-স্বশিক্ষিত-বিনয়ী ও সুভদ্র মানুষদের এটাই বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে৷
গতি-কাফেলায় স্টাফ হয়ে বেশিদিন থাকা হয়নি আমার৷ কিন্তু আজীবন ( ১৯৮১—১৯৯৩ ) সম্পর্ক রক্ষা করে আর নিয়মিত লিখে এসেছি৷
ইমাম চাচাজীর সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসের দিকে৷ ওই বছর নভেম্বর মাসে ঢাকায় যাওয়া আর ফেরার মধ্যে তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি৷
পরে জানতে পারি তিনি ইহলোকে আর নেই৷

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর