কেন একজন মুসলিম হিসেবে আমি বাবরির পরিবর্তে দেওয়া ‘জাতিগত পরাজয়ের প্রতীক’ জমি গ্রহণ করবো না

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

IMG_20210619_105952

পাঠকের কলমে : ৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধংসের স্মরণে এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ৯ ই নভেম্বর, ২০১৯ এর আদেশে উত্তরপ্রদেশ সরকার ধনিপুর গ্রামে একটি মসজিদ-সহ-মাল্টি-ইউটিলিটি কমপ্লেক্স নির্মাণ করছে, যা ২২  মূল বাবরি মসজিদ থেকে কিমি দূরে। সম্ভবত, এটি ভারতীয় মুসলমানদের  জাতিগত পরাজয় লালন করার জন্য নির্মিত প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ, যা গৌরবের সঙ্গে আমরা নির্মাণ করতে যাচ্ছি।

গ্র্যান্ড মসজিদ কমপ্লেক্সের মধ্যে পরিকল্পিত রয়েছে একটি হাসপাতাল, একটি গ্রন্থাগার, একটি যাদুঘর। আশ্চর্যজনক বিষয় হল এটি এমন একটি গ্রামের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হতে চলেছে যেখানে বেশিরভাগ মানুষের প্রাথমিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। আবার ইতিমধ্যে কম সংখ্যক মুসল্লির বিপরীতে অনেকগুলি মসজিদ রয়েছে গ্রামটিতে।  ধন্নীপুর স্মৃতিস্তম্ভের স্বপ্নদর্শীদের ক্ষেত্রে, এটি স্থানীয়দের জন্য নির্মিত হবে না, বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার পর্যটক আসবেন তাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এটি প্রস্তুত হবে। তারা সবাই এখানে ভারতের তথাকথিত সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য এবং বৈচিত্রের এক ঝলক অবলোকন করবেন। তাদের নজরে আসবে একটি জাতি কিভাবে এক ঐতিহাসিক পরাজয় স্বীকার করেছে। তাদের নজরে ভেসে উঠবে কিভাবে দেশের সরকারের প্রচ্ছন্ন মদিতে উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা ঐতিহাসিক এই মসজিদের প্রতিটি ইট ভেঙেছিল।

অবশ্যই, এই হাজার হাজার পর্যটক প্রথমে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্দান্ত এবং বিতর্কিত স্থাপত্য রাম মন্দির, অযোধ্যার বিজয় স্মৃতিসৌধটি পরিদর্শন করবেন। তারপরে ২২ কিলোমিটার দূরে পৌঁছাবেন। আশা করি ততদিনে রাম মন্দির থেকে বাবরির পরিবর্তে তৈরি মসজিদের মধ্যেকার রাস্তা এক বিজয় করিডোরের রূপ নেবে। প্রচার করা হবে ভারতীয় বহুবচনবাদের বুলি। শুধু মসজিদ দ্বারা বহুত্ববাদ কেন চিহ্নিত করা উচিত তা বোঝা মুশকিল অবশ্য।

যেহেতু কেবলমাত্র মুসলমানরা একটি মসজিদ তৈরি করতে পারে, তাই এই কমপ্লেক্সটি নির্মাণের জন্য ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন গঠনের জন্য উত্তর প্রদশের যোগী সরকার চির নমনীয় উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সুন্নি কেন্দ্রীয় ওয়াক্ফ বোর্ডের ওপর দায়িত্ব দেয়।  ট্রাস্টের নিজস্ব কোনও তহবিল নেই।  এটি মুসলিম নাগরিকদের উদারতার উপর নির্ভর করবে বা ওয়াকফ বোর্ডের কোষাগারের ওপর।

দেশব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ওয়াকফ বোর্ডগুলি চূড়ান্তভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ, এটি সর্বজনবিদিত সত্য।  কয়েক বছর ধরে, মিডিয়া প্রায়শই রাজ্য জুড়ে ওয়াকফ বোর্ডের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ করে আসছে।  খেলাধুলার সংস্থাগুলির মতো, ওয়াকফ বোর্ডগুলি উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতিবিদদের স্বপ্নের ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এর পরে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে উত্তর প্রদেশের ওয়াকফ বোর্ড এই অঞ্চলে এই মসজিদ কমপ্লেক্স তৈরি করছে। যেখান থেকে অন্যান্য মুসলিম সংগঠনগুলি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

তবে, বাবরি মসজিদ হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ধ্বংস হওয়ার পরও তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রদত্ত জমি নেওয়ার বিষয়ে আমার আপত্তি উত্তর-প্রদেশ ওয়াক্ফ বোর্ড বা এর বংশধর ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশনের সুবিধাবাদের সাথে খুব একটা সম্পর্কিত নয়। আমার আপত্তি চারটি কারণ থেকে শুরু হয়।

এক, বাবরি মসজিদ ইস্যুটির প্রকৃতি আর যা-ই হোক তা কখনও জমির বিরোধ ছিল না। যদি শুধু জমির বিষয় হত তাহলে মুসলিমরা খুশি মনে ধন্নিপুরে দেওয়া জমি গ্রহণ করত। শুধু জমির বিষয় হলে মুসলিমরা ১৯৮০ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত এক টুকরো জমির লোভে এই পরিমাণ জীবনের আত্মাহুতি দিত না। ৬০০ বছরের বেশি ভারতের বেশিরভাগ ভূখণ্ডের ওপর রাজত্ব করা মুসলিমরা এই এক টুকরো জমির জন্য এতদিন লড়াই করত না। এটা ছিল নাগরিক হিসেবে মুসলিমদের সাংবিধানিক অধিকারের লড়াই। এটি ছিল জাতিগত আত্মসম্মানের লড়াই। এটি ছিল ন্যায় বিচারের লড়াই। তাই নিজেদের আত্মসম্মান, নাগরিক হিসেবে সাংবিধানিক অধিকার এবং ন্যায়ের অধিকারের পরিবর্তে এক টুকরো জমি গ্রহণ আমাদের কাছে দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সামিল।

দুই, যদিও বিভিন্ন মুসলিম শাসকগণ তাদের মহিমাটির প্রতীক হিসাবে মসজিদগুলি নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু ইসলামে মসজিদগুলির একটি খুব প্রাথমিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এটি এমন একটু স্থান যেখানে মুসলিমরা এখানে জামাতে নামাজ আদায় করতে পারে।  সুতরাং, একটি মুসলিম সম্প্রদায়ের উপস্থিতির উপর মসজিদের উপস্থিতি মুসলিমদের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে। তাই যেখানে মুসলিমদের নামাজের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক মসজিদ একটা সেখানে জোরপূর্বক এমন একটি মসজিদ নির্মাণ সম্পদের অপব্যবহার। এটি সত্যিকারের মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতিতে অন্যভাবে কাজে লাগানো যেত।

তিন, বিদ্যমান মসজিদগুলি ইতিমধ্যে অনেক বেশি, নতুন ধর্মীয় কাঠামো তৈরির পরিবর্তে, অর্থটি অন্য উন্নয়ন মূলক কাজে ব্যবহার করা যেত।  উত্তরপ্রদেশ সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ওখানে ৫ একর জমি দিতে উদ্যোগ হওয়ার সময় ওয়াকফ বোর্ডকে দেখা উচিত ছিল ধন্নিপুররে মুসলিমদের সব থেকে বেশি কিসের প্রয়োজন।  কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, লোকেরা আসলে একটি ডিগ্রি কলেজ চেয়েছিল।  স্পষ্টতই, এটি আরও উপকারী হত।

সর্বশেষে, রাম মন্দিরের সঙ্গে অযোধ্যা কালের অন্তরালে একটি হিন্দু একটি হিন্দু পরিচিতি লাভ করবে। বাবরি মসজিদ তার অস্তিত্ব নকল এক স্থাপত্যের মাঝে টিকিয়ে রাখার ব্যার্থ চেষ্টা করবে যা ন্যায় বিচারের পরিবর্তে দয়ার এক দান হিসেবে দেখা হবে। পুরো অযোধ্যা এক হিন্দু তীর্থক্ষেত্র এর রূপ নেবে। অন্যদিকে মুসলিমরা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ওপর নিজেদের অধিকার বিসর্জন দিয়ে ন্যায়ের অধিকার ছেড়ে দিয়ে ধিন্নিপুরের মসজিদ কমপ্লেক্সকে গ্রহণ করে আরো অনেক বাবরি তৈরির পথ সুগম করে দেবে। হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদের ধংসের পথ অনুসরণ করে দখলে উদ্যত হবে একে একে মথুরা ঈদগাহ মসজিদ, কাশি জ্ঞানভাপী মসজিদ, বারানসি মসজিদগুলো। এই চরম অপমান থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার না হলে মুসলমানরা কোনো কালে হারাতে পারে তাজমহল, কুতুব মিনার, জামে মসজিদের মতো ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও।

সূত্র : The Scroll

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর