স্মরণে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান স্যার

~আবদুল মোমেন

মানুষটি অত্যন্ত স্পষ্টবাদী। সঠিক কথাটা বলার জন্যে বিশেষ সময়ের অপেক্ষা না করা মানুষটি হলেন মনিরুজ্জামান স্যার। যতটুকু শুনেছি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণটা ছিল তাঁরই দেওয়া। তৎকালীন মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সাত্তার সাহেব মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার উদ্বোগ নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কি হবে সেটা নিয়ে শতাধিক বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে একটা মিটিং করেছিলেন বিধানসভার নওশের আলি সভাকক্ষে। সেই সভায় নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতামত উঠে আসে। মনিরুজ্জামান সাহেবের প্রস্তাব ছিল – যেহেতু আলিয়া মাদ্রাসা নামের মধ্যে একটা ঐতিহ্য রয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হোক আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এটাই সকলের গ্রহণযোগ্য হল।

নাম হল আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। মন্ত্রী আব্দুস সাত্তার সাহেব ওনাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। মাঝে মাঝে মনিরুজ্জামান সাহেব মন্ত্রীর কাছে আসতেন। একদিন মন্ত্রী ওনাকে বলেন যে আপনি আমার কাছে এলে আমার বুকটা পাঁচ হাত হয়ে যায়। আপনার মত পণ্ডিত মানুষের সাহচর্য পেলে অনেক বুদ্ধি খুলে যায়। এমন কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এক ঘর বিশিষ্ট মানুষদের মাঝে বলেদেন-” ওসব গ্যাস মারা বন্ধ করুন। সামনে আমাকে ফুলিয়ে দিচ্ছেন আর পিছনে বাঁশ দিতে ছাড়েন না।” মন্ত্রী তো থতমত খেয়ে গেলেন। সামলে নিতেই কেন স্যার কেন? মুড অফ? বলুন আপনার কি খেদমত করতে পারি। কিছু খেদমত করতে হবেনা। ফাজিল রিকগনেশনগুলো কবে ছাড়ছেন বলুন। ওহ আচ্ছা । ১৫ তারিখ ক্যাবিনেট আছে ওই দিন রাতেই আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি।

এটা ছিল ওন শেষ দিকের দেখা একটা মেজাজ। তার আগে উনি আমাদের মাদ্রাসা ছাত্র ইউনিয়নের সাহায্য করতে অনেক পরামর্শ এমনকি যখন শাসন করার দরকার ছিল চড়া মেজাজে শাসন করেছেন। তাই আমরা ওনাকে পিতার মত ভাবলেও ভিতরে ভিতরে ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কখন আমাদের উপর রেগে যান। অত্যন্ত ছাত্র দরদি ছিলেন। আমরা প্রায়ই ইউনিয়নের কাজে টাকা ধার নিতাম। চাইতে গেলে বলতেন তোরা সেই ওই টাকাটা তো আমাকে ফিরিয়ে দিসনি আবার নিয়ে দিবিনি। এমন বলতেন এই বলার মধ্যে যে অনুরাগ থাকতো আমরা তা বুঝতে পারতাম। তাই জোর করে চেপে ধরে টাকা নিয়ে আসতাম। দিতেন আর বলতেন নিয়ে যা-না যদি দিস তো কিয়ামতের দিন আদায় করে নেব। আমরা কথাটার মানে বুঝতে পারতাম তাই খুব জোরে হাঁসি দিয়ে চলে আসতাম।

অত্যন্ত রসিক আবার কড়া মেজাজের ছিলেন। উনি বার্ধক্য বয়সে অনেক কষ্টে আমার বাড়িতে এসেছিলেন। সেই আসার দিনটার কথা আমি ভুলতে পারবোনা কোনো দিন। আজ এখন সেই দিনটার কথা মনে পড়ে গেল চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না।

২০১৫ এর ২৩ ডিসেম্বর পার্ক সার্কাস ময়দানে মিলন মেলাতে স্যারের সঙ্গে দেখা হয়। ওনার সঙ্গে ছিলেন ওনার মেয়ে মনিরা খাতুন। আমার সাথে ছিল আমার স্ত্রী। দেখা হতেই সালাম কালাম ইত্যাদির পর প্রসঙ্গ তুললেন কিরে – কমিশন না কমিটি তোরা কোন দিকেরে? তোরা নাকি কমিশনের পক্ষে? আমি একটু ভয়ে ভয়ে হাঁ স্যার আমরা কমিশনের পক্ষে। কেন? আমার পক্ষে বলে যেতে লাগলাম উনি শুনে যেতে লাগলেন। আমি অবাক হচ্ছিলাম উনি তো এতক্ষণ ধরে শোনা মানুষ নন আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করেন কিন্তু করছেন না কেন? ভাবছিলাম হয়তো আমাকে বেশি বলিয়ে কথার জালে বেশি করে জড়িয়ে ফেলতে বেশি খেলিয়ে নিচ্ছেন। এমন আশঙ্কা মনে মনে করেই চলেছি। শেষে কেবল একটাই কথা বলেছিলেন যাই হোক কিন্তু কমিশন থাকলেও সাংবিধানিক অধিকারের বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে। এই কথা বলতে বলতে আমার কথা জড়িয়ে যায়। ভাবলাম স্যারের সাথে কথার জন্যে টেনশনে এমন হল বুঝি। আবার একটা কথা বললাম ফের জড়িয়ে যায়। আমি কিছু না বলে স্যারকে বললাম স্যার আমি একটু আসছি। বলেই চলে আসলাম। স্যার কিছুক্ষণ নাকি অবাক হয়েছিলেন। কেন এমন করে চলে গেল।

আসলে ওই মুহূর্তে আমার স্ট্রোক হয়ে গেছিল। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্যার অনেক রাতে খবর শোনেন। শুনে খুবই আফসোস করেন। মেয়ের সাথে আমার সমস্ত ঘটনা স্যার বলেন। আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে স্যার মেয়ে জামাই নাতি এবং ওনার সর্বসময়ের প্রিয় ছাত্র মাওলানা আব্দুল ওহাব সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আমি তখন বিছানা শয্যায়। স্যার এসে আমাকে বলেছিলেন তোর মত লড়াকু ছাত্রকে বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় দেখতে এলাম এটাই আমার কষ্ট। আজ স্যার নেই। ভাবতেই পারছি না। বেশ অনেক দিন স্যারের সাথে কথা হয়নি। অসুস্থ সংবাদ পেয়েছি কিন্তু দেখতে যেতে পারিনি। চির বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছেন। শেষবারের মত মুখটা দেখতে যেতে পারলাম না। স্যার আমাকে ক্ষমা করবেন।

আল্লাহ স্যারকে ক্ষমা করে দিন। তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।

আবদুল মোমেন (প্রাক্তন ছাত্র)

Latest articles

Related articles