বেলডাঙার চিনিকল! মুর্শিদাবাদ জেলাকে শিল্প থেকে বঞ্চনার এক মূর্ত প্রতিচ্ছবি

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

WhatsApp Image 2022-11-11 at 10.42.55 PM

~শরীয়তুল্লাহ সোহন

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর মুর্শিদাবাদ। ইতিহাস সমৃদ্ধ এই জেলাটি এক সময় ছিল অখন্ড বাংলা-বিহার-ঊড়িষ্যার মতো বিস্তীর্ণ এলাকার রাজধানী। কাঁচামালে সমৃদ্ধ এই শহরটি বরাবরই ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মূল আর্কষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। শুধু তাই নয় বণিকের বেশে উপমহাদেশের বুকে আসা ইংরেজ শক্তির অন্যতম গর্ভনর লর্ড ক্লাইভ তৎকালীন সময়ে এই মুর্শিদাবাদের শিল্প সমৃদ্ধ পরিবেশ ও কাঁচামালের সমৃদ্ধতা দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সেই সময় ইংল্যান্ডের রাণীকে এই মর্মে চিঠি লেখেন, “লন্ডনের থেকেও বহু গুণাংশে এগিয়ে মুর্শিদাবাদ। “

কিন্তু পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মুর্শিদাবাদের যে বিপরীতমুখী অবনতির চলন শুরু হয়েছিল তা এখনও পর্যন্ত বিদ্যমান। ইংরেজদের হাত ধরে যে মুর্শিদাবাদ তার মূল ঐতিহ্য হারিয়ে শোষণ যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল,  তা কালের ইতিহাসের নিষ্ঠুর বিবর্তনে এখনও রয়ে গেছে। তাইতো স্বাধীনতার ৭৫ টি বসন্ত পার হয়ে গেলেও এখনও মুর্শিদাবাদ সেই শোষিত, অবহেলিত, বঞ্চিত জেলা হিসেবে পড়ে রয়েছে । একসময় যে মুর্শিদাবাদ বলতে মানুষ জানত এক সমৃদ্ধশালী এলাকার নাম,  সেই মুর্শিদাবাদ আজ লেবারের জেলায় পরিণত হয়েছে। ৮০ লক্ষেরও অধিক আবাদি সম্পন্ন বিস্তৃর্ণ জেলায় না আছে যথেষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়, না আছে কোন শিল্প কেন্দ্র বা ভালো কর্মসংস্থান । ফলে প্রতিনিয়ত এই জেলার মানুষ রুটি রোজগারের টানে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পাড়ি দিচ্ছে ভিন রাজ্যে। 

স্বাধীনতার পূর্বে এই মুর্শিদাবাদে যে কয়েকটি শিল্পকেন্দ্র ছিল, তা স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন ছুঁতায় বন্ধ হয়ে গেছে। এই শিল্পকেন্দ্র গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল, ‘বেলডাঙার চিনিকল’। একসময় অর্থাৎ স্বাধীনতার পূর্বে এই চিনিকল কে কেন্দ্র করে বহু মানুষের কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছিল। কৃষির জন্য উপযুক্ত উর্বর মাটি সম্পন্ন এই জেলায় প্রচুর পরিমাণে আখ চাষ শুরু হয়েছিল। 

লালগোলা টু শিয়ালদহ রেলপথের ধারেই বেলডাঙায় এই চিনিকল টি উপস্থিত। ইতিহাস দেখলে জানা যায় এই চিনিকলটি ১৯৩৩ সাল নাগাদ স্থাপিত হয় । যে জায়গায় চিনিকল টি গড়ে উঠেছে সেই জায়গায় আগে ছিল চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের কারখানা। ১৯৩৩ সালে তৎকালীন সময়ের অন্যতম শিল্পপতি শ্রী রাধাকিষাণ ঝাঝারিয়ার তত্ত্বাবধানে ইংল্যান্ড থেকে কলের জিনিসপত্র আনা হয় কলটি নির্মাণের জন্য। তাই শ্রী রাধাকিষাণ ঝাঝারিয়ার নামেই এই মিলের নাম রাখা হয়, ‘শ্রী রাধাকিষাণ সুগার মিল’। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে জানা যায়, নির্মাণের একবছর পর থেকে অর্থাৎ ১৯৩৪ সাল থেকে ব্যাপকহারে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। পাশাপাশি চিনিকল টি তে ছিল ব্রিটিশ আমলের চাকচিক্যময়তা ও আভিজাত্যের ছোঁয়া। 

এই মিলে প্রতিনিয়ত অঢেল পরিমাণে আখের জোগান দিতে হত। যার বেশীরভাগই আসত তৎকালীন সময়ে অবিভক্ত বাংলার রাজশাহী জেলা থেকে। এছাড়াও তখন মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং নদীয়ায় আখ চাষের জন্য প্রচুর পরিমাণে উৎকৃষ্ট জমি ছড়িয়ে ছিল । সেই বিস্তৃর্ণ জমিগুলোতে ব্যাপকহারে উৎকৃষ্ট মানের আখ চাষ হত। ফলে এই মিলে উৎপাদিত চিনির মান উন্নততর হওয়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে বিলেতের বাজারেও এই চিনির ব্যাপক চাহিদা ছিল । সেই সুবাদে দেশ-বিদেশে মুর্শিদাবাদ সহ বেলডাঙার খ্যাতি বিশেষভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের চক্করে পড়ে নানারকম ঝামেলা, ফ্যাসাদ ও আইনি জটিলতায় চিনিকল টি বন্ধ হয়ে যায়। 

 তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত চিনিকল টি বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় নানা সরকার এলেও কেউ আশার আলো দেখায়নি। তবে ১৯৯৩ সালে বামফ্রন্ট সরকারের কাছ থেকে এই সুগার মিল সহ, তার পাশের জমি লিজে নেয় চাঁপদানি ইন্ড্রাস্ট্রি। তারা সেখানে পাটজাত নানা শিল্প তৈরির কথা বলেছিল। শুধু তাই নয় স্বাধীনতার পরে রাজ্যের ক্ষমতার মসনদে কংগ্রেস সরকার ২৭ বছর থাকলেও তারাও কোন প্রকার মাথা ঘামায়নি চিনিকলটি নিয়ে। বরং চিনিকল টি কে নিয়ে নানারকম ঘৃণ্য চক্রান্ত করে এসেছে। যেমন বাম জমানায় বেশ কয়েকবার মিলটিকে প্রমোটারদের হাতে তুলে দিতে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রবল গণ আন্দোলনের চাপে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আর এই গণ আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন বাম সরকারের বিধায়ক তিমির বরণ ভাদুড়ী। নিজে বামপন্থী লোক হয়েও বামদের বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হয়েছিল। ফলস্বরূপ তাকে পরবর্তী নির্বাচনে একপ্রকার জোর করে পরাজয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল সরকার। আর এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের পিছনে আর. এস. পি এর অন্যতম সংগঠক সুরেশ ভদ্রের বিশেষ হাত ছিল। 

তবে ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতার মসনদে পালাবদল ঘটলে মানুষজন আবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করে মিলটিকে নিয়ে। কারণ রাজ্যের মাননীয়া মূখ্যমন্ত্রী ঢোল পিটিয়ে নানারকম প্রতিশ্রুতির আশ্বাস দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ২০১৬ সালে মুর্শিদাবাদ সফরে এসে বেলডাঙার এক জনসভায় চিনি কলটির ব্যাপারে বলেন এবং সেই দিনের জনসভার মঞ্চ থেকে প্রতিশ্রুতি দেন এবং দ্রুত ব্যাপারটি কে পর্যালোচনা করার আশ্বাস দেন। পাশাপাশি তিনি বেলডাঙায় এই চিনিকলটি কে কেন্দ্র করে শিল্প গড়ে তোলার ভাবনা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এগুলো যে সব ফাটা  বাঁশির আওয়াজ ছিল তা জেলার মানুষ সময়ের তালে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। তাইতো আজও ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া শ্রমিকরা পথে যেতে যেতে পরিত্যক্ত চিমনীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর ভাবে যদি শিল্পটা যদি বেঁচে থাকত  তাহলে এমন করে পরিবার পরিজন ছেড়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হতো না। হয়তো এখান থেকে প্রতিদিনের রুটি রোজগারের পথটি হয়ে যেত। তবে বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতাসীন সরকাররা যতই বঞ্চনা, ছলনা করুক না কেন! তবুও জেলার মানুষ আজও স্বপ্ন দেখে কলের চিমনি দিয়ে আবার ধোঁয়া উড়বে, কলের মেশিন আওয়াজ করে চলবে, শ্রমিকদের চিৎকারে মুখরিত হয়ে উঠবে চারিদিক। সর্বোপরি আর্থ ও সামাজিকভাবে বেলডাঙা সহ পুরো মুর্শিদাবাদ জেলার চিত্র বদলে যাবে। 

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর