দোস্তজি; বন্ধুত্বের জন্য জীবন যুদ্ধের লড়াই-এ নিজেকে আত্মপ্রতিষ্ঠিত করা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত 

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

Screenshot 2022-11-19 205824

~তসমিনা খাতুন

বন্ধুত্ব’,’দোস্ত’, ‘ফ্রেন্ড’, পৃথিবীর ভাষা ইতিহাসে নামগুলি শুনতে পার্থক্য বোঝালেও, যুগে যুগে সেই সৃষ্টির শুরু থেকে চলমান জীবন পর্যন্ত একই গভীর অর্থ বহন করে চলেছে।

বাবা, মায়ের পরে যদি কাউকে রক্তের সম্পর্কের বাইরে গিয়ে খুঁজি তা হলো বন্ধুত্ব। আমরা প্রত্যেকই মনের গহীনে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি লালনপালন করি; যত্ন নিই – সেটাই প্রকৃত বন্ধুত্ব। আধুনিক চলমান যান্ত্রিকতার যুগে বন্ধুত্ব শব্দটি যেখানে ‘টাল-মাটাল’ অবস্থায় প্রশ্নে বিদ্ধ,  ঠিক তখনই আমাদের মতো আটপৌরে মানুষদের উপহার দিয়ে যাই – পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায় বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় তার “দোস্তজী” নামক ছবিটি।

 প্রথমত, বলতেই হয় আমরা যে মুর্শিদাবাদ -এর সংস্কৃতি, মানুষজন নিয়ে সমালোচনায় মুখর থাকি,  সেই অঞ্চলের দুই খুদে শিল্পী আরিফ শেখ(সফিকুল), আশিক সেখ(পলাশ) আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, এছাড়াও ছবিটির ঝুলিতে রয়েছে অসংখ্য পুরস্কার। গল্পের স্থান হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে মুর্শিদাবাদেরই একটা প্রত্যন্ত অঞ্চল, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

দোস্তজি ছবির একটি দৃশ্য

 ‘দোস্তজী’- সম্পর্কে একটু বলা যাক: সফিকুল এবং পলাশকে পর্দায় দেখে মনে হয়নি যে তারা অভিনয় করছেন; বরাবরই মনে হচ্ছিলো আমার সামনে দুইজন বন্ধু তাদের কথা ব্যক্ত করেই চলেছে যা মোহমুগ্ধকর।

অভিনয় প্রসঙ্গে আরও দুইজন চরিত্রের কথা না বললেই নয়: প্রথমত, পলাশের মায়ের চরিত্রে জয়তী চক্রবর্তীর বাকরুদ্ধ করা নীরব কঠিন আর্তনাদ অভিনয় ভয়ংকর রুপে দুদার্ন্ত। 

দ্বিতীয়ত, মাস্টারের ভূমিকায় অনুজয় চট্টোপাধ্যায়কে যখন দেখি সফিক স্কুলে পঞ্চম স্থানে অবস্থান করায় দৌঁড়ে গিয়ে সফিককে তার বাড়িতে দেখতে গিয়ে মাস্টারমশাই -এর চোখের কোণ আনন্দের সাথে অশ্রুসিক্ত হয়, সেই সঙ্গে আমাদের চোখ ভারাকান্ত করে।

বন্ধুত্ব যে জাতি,  বর্ণ, গোত্র সবার উর্ধ্বে ; সর্বোপরি সম্প্রীতির বন্ধন পলাশ ও সফির বন্ধুত্বে দেখিয়েছেন,  দৃষ্টান্ত আরও দেখি যে- ‘খান-সাউন্ড’ মাইক থেকে গ্রামের রাম-রাবণ পালার ঘোষনা,তাছাড়া মসজিদ তৈরি বালি থেকে কিছুটা সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে দেখা যায় সফিককে, ঝুলনের পাহাড় বানাবে বলে পলাশের বাড়িতে। এছাড়াও পলাশ তার বোনকে সফিকের বাড়ির ঈদের সিমাই খাওয়ানো তার মায়ের চোখের আড়ালে গিয়ে এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত সম্প্রীতির।

মুর্শিদাবাদের একটি গ্রামে একই বেড়ার ব্যবধানে নিম্নবিত্ত দুটি পরিবারে পলাশ ও সফিকুলকে পাশাপাশি বাস করতে দেখা যায়। 

একসঙ্গে স্কুলে পড়া, ভ্যান চেপে টিনের বাস্ক নিয়ে স্কুলে যাওয়া,  একসঙ্গে সন্ধ্যায় জোনাকি ধরতে যাওয়া, এই সব দৃশ্য আপনাকে শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, সেই সঙ্গে মনে করায় ‘পথের পাঁচালী’ অপু দুর্গার কথা।

হয়তো আমরা অনেকেই শৈশব কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উপনীত হয়ে হারিয়ে ফেলেছি প্রকৃত বন্ধুকে, বরং এখানে সফিকুলের মাধ্যমে আমাদের বাঁচতে শেখাই,  কারণে-অকারণে, বা বিধাতার কাছে আমরা যারা হারিয়ে ফেলেছি এরকম বন্ধুদের,  সেই বন্ধুর প্রতীকী হিসাবে বন্ধুর জন্য বাঁচা,সর্বোপরি লড়াই করে টিকে থাকা,  তারই দৃষ্টান্ত দেখি যে, সফিক পড়াশোনা না করলেও বন্ধু পলাশ না থাকায়,  শ্রেণিকক্ষে পলাশের স্থান অধিকার করতে চেয়েছে সফিক।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পরিচালক নিখুঁত বন্ধুত্বের যে মোড়ক উন্মোচন করেছেন সাবলীলভাবে তা বার বার আমাদের চোখের কোণ অশ্রুসিক্ত করে।

সেইজন্যই হয়তো যে বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে শুঁয়োপোকার চলার গতি থেকে শুরু হয়ে প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলে চলে যায় তখন আমাদের আাহত ও মর্মাহত করে।

প্রসেনজিতের সঙ্গে ছবির অভিনেতা ও পরিচালক

তাই বলাই বাহুল্য নবীন পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায় অতিরঞ্জিতহীন, অতিবাহুল্য বর্জিত,  অতিনাটকীয়তাহীন,  তুহিন বিশ্বাসের ক্যামেরার রোশনাই সিনেমাটোগ্রাফির ঝলকানিতে, পুরনো দিনের গানের সুরে এবং সাত্যকী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে, সর্বোপরি দলবদ্ধ প্রচেষ্টাই একটা নতুন আঙ্গিকে বন্ধুত্বকে খুঁজে পেতে,  শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করতে একবারও হলেও প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখুন। আর এইরকমই ‘দোস্তজী’- র অনুসন্ধান করতে থাকুন।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর