বেগম রোকেয়া : নতুন দিনের আলো

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে, অন্ধ সে জন,মারে আর শুধু মরে। (2)

কখনও কখনও যখন যুদ্ধ দীর্ঘ হয় এবং সমাপ্তিতে বিজয়ের কোন আশা থাকে না, তখন ছোট ছোট বিজয়ের উপর নির্ভর করা ভাল। আশি বছর আগে, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তার নারীবাদী ইউটোপিয়ান ফ্যান্টাসি সুলতানার ড্রিম প্রকাশ করেছিলেন। লিঙ্গ- বৈষম্যের  ভারতের বিড়ম্বনাগুলি অনুসন্ধান করে এই উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। তাঁর উপন্যাসে তিনি পুরুষদের কল্পিতভাবে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন “জেনানা”-র মধ্যে। জেনানার অর্থ একটি ঘরের অংশ। নারীর নির্জনতা সুলতানা নামের একজন মহিলার স্বপ্ন দিয়ে বুনেছিলেন বেগম রোকেয়া তাঁর লেখাই।

 

1880 সালে পায়রাবন্ধের (বর্তমান বাংলাদেশ) একটি ধনী জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, রোকেয়া বেগম। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, লেখিকা, সামাজিক কর্মী এবং ভারতের প্রথম বাঙালি ইসলামবাদী-নারীবাদী। তার বাবা ছিলেন একজন গোঁড়া মুসলিম। তিনি সর্বদায় তাঁর মেয়েদের পর্দার আড়ালে রেখে কেবলমাত্র আরবি শিখে কোরান পড়ার উপর জোর দিয়েছিলেন। রোকেয়া এবং তার বোন করিমুন্নেসা, তার ভাইদের সাহায্যে গোপনে বাংলা এবং ইংরেজি শিখেছিলেন।

 

কারিমুন্নেসা, রোকেয়ার বোন, যিনি অত্যন্ত গুনি লেখিকা ছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। এই বিবাহ একজন গুনি লেখিকাকে কেড়ে নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। বোনের বিবাহের যন্ত্রণা রোকেয়াকে নারীদের শিক্ষাগত এবং ব্যক্তিগত অধিকারের জন্য লড়াই করতে সাহস দিয়েছিল। যে যুগে মুসলিম মহিলারা কাঠের বাক্সের মধ্যে লোহার পর্দা নিয়ে বাস করার মতো করে বাঁচতেন, সেই যুগে দাঁড়িয়ে বেগম রোকেয়া অধিকারের ইস্তেহার ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর লড়াই যে মোটেই সহজ ছিল না তা বুঝতে আমাদের কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

 

রোকেয়ার এই লড়াইয়ের কাণ্ডারি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর স্বামী সাখওয়াত হোসেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার সঙ্গে বিবাহ হয় সাখওয়াত হোসেনের। বিয়ের পর স্ত্রী স্বপ্নপূরনের হাল ধরেন তিনি। কিন্তু এক সঙ্গে এই লড়াই বেশিদিন লরতে পারেননি তাঁরা। লড়াই শেষ হওয়ার আগেই ছন্দপতন ঘটে। ১৯০৯ সালে মারা যান রোকেয়া বেগমের স্বামী সাখওয়াত হোসেন।

মৃত্যুর পাঁচ মাস পর ভাগলপুরে নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে রোকেয়া সাখাওয়াত গার্লস মেমোরিয়াল হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন বেগম রোকেয়া। মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে (পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ-উর্দুভাষী এলাকা) স্কুলটি শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯১১ সালে শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে স্কুলটি কলকাতায় স্থানান্তর করতে বাধ্য হন রোকেয়া। বর্তমানে এটি মেয়েদের জন্য শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কুলগুলির মধ্যে একটি এবং এখন এটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার দ্বারা পরিচালিত ৷

১৯১৬ সালে, তিনি আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম (ইসলামিক মহিলা সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল বাঙালি মুসলিম মহিলাদের জন্য এক অন্যতম সংগঠন। এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি দরিদ্র মুসলিম নারীদের আর্থিক ও শিক্ষাগত সহায়তা প্রদান করেন, মুসলিম নারীদের অধিকারের বিষয়ে জনমত গড়ে তোলেন। রোকেয়া তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। তার স্থাপিত স্কুলের পাঠ্যক্রমে তিনি নারীদের আর্থিক স্বাধীনতার সাথে সজ্জিত করার প্রয়াসে শারীরিক ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন সেই যুগে।

তিনি “মানসিক দাসহোত্তো ” বা মানসিক দাসত্ব নামে একটি শব্দ লিখেছিলেন। যে শব্দের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন মেয়েদের ব্যক্তিত্বের অনুপস্থিতি, যা তাদের পরাধীনতার মূল কারণ।

তিনি লিখেছেন , “মুসলিম সমাজে মহিলাদের জন্য শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকার জন্য একটি বড় মূল্য দিতে হচ্ছে। আমাকে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানানো হয়েছে যে, সচ্ছল পরিবারের কিছু শিক্ষিত মুসলিম যুবক এমন শর্ত দিয়েছে যে যদি তারা শিক্ষিত মুসলিম নারী খুঁজে না পান, তবে তাঁরা বিয়ে করবেন না। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কাউকে বিয়ে করে খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছেন।”

১৯২৬ সালে, যখন তাকে বেঙ্গল উইমেনস এডুকেশনাল কনফারেন্সের সভাপতিত্ব করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তিনি চিঠিদাতাকে বলেছিলেন , ” আপনি আমাকে সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে আমার প্রতি যে সম্মান প্রকাশ করেছেন তার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনি আমাকে সঠিক নির্বাচন করেননি। আমি সারাজীবন ‘পর্দা’ অর্থাৎ সামাজিকভাবে নিপীড়নমূলক লোহার কক্ষে বন্দী রয়েছি। আমি মানুষের সাথে খুব ভালভাবে মিশতে পারিনি। আসলে, আমি জানি না একজন চেয়ারপারসনের কাছে মানুষ কী আশা করে। আমি জানি না আমার বক্তব্যে কেউ হাসবে নাকি কাঁদবে।” এহেন সম্মান পেয়েও নিজের ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার মতো সাহস বোধহয় তিনি রোকেয়া বলেই দেখাতে পেরেছিলেন।

বেগম রোকেয়া তার মতামতের জন্য শুধু কঠোর সমালোচনার শিকারই হননি, তার সঙ্গে ক্ষমাহীন সামাজিক বর্জনেরও সম্মুখীন হন। বিচিত্র প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, রোকেয়া লিঙ্গ,সম্প্রদায়,শিক্ষা নিয়ে তাঁর লড়াই চালিয়ে যান। তাঁর সেই লড়াইয়ের সুফল ভোগ করছে আজকের মুসলিম নারীরা।

১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া মারা যান। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন রাত ১১টা পর্যন্ত তিনি “নারীর অধিকার ” শিরোনামের একটি অসমাপ্ত প্রবন্ধে কাজ করছিলেন। মুসলিম সমাজের জন্য স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের আলিগর আন্দোলনের কথা শোনা যায় ইতিহাসে বারংবার। কিন্তু রোকেয়া মুসলিম সমাজের নারীদের জন্য যে লড়াই লড়েছেন, সে কাহিনীকে আমাদের ইতিহাস বিলিন করে রেখেছে। আজ রোকেয়ার স্মৃতি অবলুপ্তপ্রায়; সুলতানার স্বপ্নের মতো। বাংলার প্রথম মুসলিম মহিলা, যিনি মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন, আজ সেই বেগম রোকেয়ার ১৪১তম জন্মদিন ও ৪৯তম মৃত্যুদিন। মুসলিম নারি শিক্ষার আলোর মশালকে জানাই শুভ জন্মদিন।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর