Monday, June 9, 2025
35 C
Kolkata

মুসলিমরা যেন ভাষা-সাম্প্রদায়িকতার ফাঁদে পা না দেয়

~মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস

আমি চিরকালই ভাষাসাম্প্রদায়িকতার ঘোর বিরোধী৷ আমি মনে করি এটা এক ধরনের কূপমণ্ডুকতা৷ রাজনৈতিক বিরোধিতা ও ভাষাবিরোধিতা এক হতে পারেনা৷

তা ছাড়া ভারত একটি বহু ভাষা , ধর্ম ও বহু সংস্কৃতির দেশ৷ এর আত্মার বাণী হল “বিবিধের মাঝে মিলন মহান”৷ আমরা সেই মহানতায় বিশ্বাসী৷ এই মিলনই ভারতের জাতীয় ও সংহতির মূলমন্ত্র৷ হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে কি হবেনা, ওটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই এবং ওই বিষয়ে আমি তর্কে যেতে চাই না৷ আমি ভাষা ও সাহিত্যের মানুষ৷ সে জন্য ওই বিষয়টি সময়ই আমার বিবেচনায় থাকে৷

নয় নয় করেও বিগত ৫০ বছর ধরে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে কমবেশী লেনদেন চলে আসছে৷ ওই ভাষার মধ্য যুগের সাহিত্যের সঙ্গে আমার যতদূর পরিচয় আছে সেই সূত্রে আমি বলতে পারি মধ্য যুগের হিন্দি সাহিত্যের ওই সময়ের সাধকেরা মরমী ভাবধারায় মানুষ, মনুষ্যত্ব ও মানবতার জয়গান গেয়ে গিয়েছেন৷ শুধু তাই নয়; তাঁরা জাতিধর্মনির্বিশেষে তাঁরা সমন্বয়ের ভাবধারা প্রচার করে গিয়েছেন৷ অথচ ওই যুগে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে নিরন্তর দেবীমাহাত্ম্য প্রচার করে বাংলায় ইসলামি অভিঘাতকে ঠেকানোর উদ্দেশ্যে প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষ ছড়িয়ে সমাজে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছে৷

হিন্দি সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার আমদানি অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন কালের কথা৷ কেউ কেউ বলেন, অবশিষ্ট ভারতবাসীর সাম্প্রদায়িকতার গুরুর ভূমিকা পালন করেছে ঊনবিংশ শতকের শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুরা৷ অথচ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে নেতৃত্বে বরণ করে জাতিধর্মনির্বিশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন৷ পরবর্তীতে কংগ্রেস বঙ্কিমী আনন্দমঠের আদর্শে “বন্দেমাতরম” দেশপ্রেমের মন্ত্র ও সংজ্ঞারূপে গ্রহণ করে ভারতীয় মুসলমানদের বুক ভেঙে দিয়ে পুরো জাতিকে বিভক্ত করে দিয়েছিল৷ তার পরের ইতিহাস অনেক প্রলম্বিত ও রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস৷ এ বিষয়ে এর বেশি যেতে চাই না৷

কথা হচ্ছিল ভাষাসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে৷ আমি বলতে চাই, সকল সাম্প্রদায়িকতার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা থেকে এসেছে৷ আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার চেয়েও ভয়ঙ্কর৷ স্বর্মীয়দের মধ্যে মারামারি হানাহানির করাল রূপ উপমহাদেশবাসী বিভিন্ন সময়ে দেখেছে৷ দেখেছে আরব দুনিয়াও৷ আরব বলয়ের একটি সমৃদ্ধ দেশ ছিল ইরান৷ ভাষার প্রশ্নে ইরান আরব দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল৷ সে বড় মধুর অভিজ্ঞতা ছিল না৷ একই ধর্মাবলম্বী মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হয়ে গেল৷ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও অসমের ক্ষত এখনও দগদগ করছে৷ এসব ছিল স্বধর্মীয়দের মধ্যে ভয়ংকর রক্তপাত৷

ইদানীং “জয়বাংলা”, “বাংলা পক্ষ” ইত্যাদি আপাতমধুর কিছু শব্দ বেশ “জনপ্রিয়” হয়ে উঠেছে৷ আমি বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের এই মর্মে সতর্ক করে দিচ্ছি তাঁরা যেন এই ফাঁদে পা না দেন৷ মনে রাখবেন, উগ্র মুসলিমবিদ্বেষী প্রতারণার নতুন ফাঁদ৷ মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার ৭৩ বছরের বাংলার ইতিহাস মুসলমানদের সঙ্গে বেঈমানী ও প্রতারণার ইতিহাস৷ এই প্রতারণার রূপকারদের এটা নয়া ষড়যন্ত্র৷

আমি মুসলমানদের বার বার সতর্ক করে দিয়ে বলছি, এই ফাঁদে পা দেবেন না৷ কেন দেবেন না?

ঐতিহাসিক যুক্তিতর্কতত্ত্বতথ্য বলছে, এরা কখনোই মুসলমানদের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলনা, আজও নয়, ভবিষ্যতেও হবেনা৷ সুতরাং সতর্ক থাকুন৷

হান্টার কমিশনের রিপোর্ট থেকে সাচার কমিশনের রিপোর্ট পর্যন্ত একও অভিন্ন tradition নির্দেশ করে৷ এর পরেও তথ্য চাই?

ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারতের অবাঙালি রাজ্যগুলিতে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের মধ্যে বাঙালি মুসলিম শ্রমিকের সংখ্যা কমপক্ষে ৯০ শতাংশ হবে৷ নিজের রাজ্যে শুধু মুসলিম বলে এদের কাজ নেই৷ ওপেন সিক্রেট ব্যাপার হল বাঙালি হিন্দুরা স্বজাতীয়দের বাইরে মুসলমানদের কাজে নেয় না৷ এ ক্ষেত্রে অবাঙালি হিন্দুরা বাঙালি হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি উদার৷ একথা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি৷

ভারতের অবাঙালি হিন্দু গরিষ্ঠ রাজ্যগুলির লোকেরা কাজের জন্য লোক নেয়, জাতধর্ম দেখে নয়৷ তারা তাদের শুধু জীবিকা না; বরং সার্বিক নিরাপত্তা দেয়৷ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, রাজনীতি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ; বাঙালি হিন্দুদের মতো রন্ধ্রে রন্ধ্রে নয়৷ এই ভারতকে আমি স্বচক্ষে দেখেছি৷

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলিমরা যদি “জয়বাংলা” আর “বাংলাপক্ষ”র ধূয়ো তুলে তাদের উপর আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেয় তাহলে তাদের জীবিকার যোগান দেবে কে? সুতরাং সাবধান৷ ও সব ভূয়ো শ্লোগানে কাজ নেই৷

মনে রাখতে হবে, হিন্দীভাষী হিন্দু আর বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলিমের দাঙ্গা বাধলে বাঙালি হিন্দুরা কায়দা করে এমনভাবে হিন্দীভাষী হিন্দুদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সম্মিলিতভাবে মুসলিম নিধনের মোচ্ছব শুরু করবে যে, বুঝতেই পারবেন না৷ তখন একজন বাঙালি হিন্দুকেও মুসলিমদের সাথে পাওয়া যাবে না৷ মুসলিমরা পাইকারি হারে নিধন হবে এবং তাদের সহায়-সম্পত্তি লুট হবে এবং বেঘর হবে৷ অতএবব, সাবধান৷ মুসলিমরা যেন কোনো অবস্থাতেই ভাষা-সাম্প্রদায়িকতার ফাঁদে পা না দেয়৷

মতামত লেখকের নিজস্ব।

Hot this week

গাজার রাফাহ সহায়তা কেন্দ্রেই মৃত্যু: ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২৭ জন ফিলিস্তিনি

ফের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় রাফাহ শহরের একটি...

মাদ্রাসা রক্ষায় আজমগড়ে সম্মেলন, আদালতের পথে জামিয়ত উলামা-ই-হিন্দ

উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে আয়োজিত হয় একটি মাদ্রাসা রক্ষা সম্মেলন...

ঈদের আগে উত্তেজনা: গাজিয়াবাদে মুসলিম মাংস বিক্রেতাকে গুলি করার হুমকি বিজেপি বিধায়ক নন্দ কিশোর গুর্জর

উত্তরপ্রদেশর গাজিয়াবাদে বিজেপি বিধায়ক নন্দ কিশোর গুর্জর সম্প্রতি একটি...

টাকার পরিমান দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গেল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার, গ্রেপ্তার ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস অফিসার

চোখ ধাঁধানো গুপ্তধনের সন্ধান। ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস অফিসার অমিত...

Topics

গাজার রাফাহ সহায়তা কেন্দ্রেই মৃত্যু: ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২৭ জন ফিলিস্তিনি

ফের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় রাফাহ শহরের একটি...

মাদ্রাসা রক্ষায় আজমগড়ে সম্মেলন, আদালতের পথে জামিয়ত উলামা-ই-হিন্দ

উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে আয়োজিত হয় একটি মাদ্রাসা রক্ষা সম্মেলন...

গাজায় ফের ইসরায়েলি হামলা!ধ্বংস করা হল ২৪০টির বেশি ঘর, নিহত হাজার হাজার নিরীহ মানুষ

গত অক্টোবর থেকে ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ হামলা চালিয়ে আসছে।...

Related Articles

Popular Categories