বাংলার ইতিহাসে মহিয়সী মহিলা আজিমুন্নেসা বেগম

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

WhatsApp Image 2022-08-27 at 11.13.16 AM

~শরীয়াতুল্লাহ সোহন

আজিমুন্নেসা বেগমের জীবনী:
আমাদের প্রচলিত ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যাবে আজিমুন্নেসা বেগম নিয়ে শুধু ভ্রান্ত ইতিহাসের ছড়াছড়ি। যার আড়ালে চাপা থেকে গেছে আজিমুন্নেসা বেগমের প্রকৃত ইতিহাস। চিরাচরিত ইতিহাস নিয়ে চর্চা করলে আজিমুন্নেসা বেগম সমন্ধে জানা খুব দুস্কর। সঠিক ইতিহাস চর্চার মনোবাসনা নিয়ে প্রচারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করলে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে তৎকালীন সময়ে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে একজন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান মহীয়সী মহিলা ছিলেন আজিমুন্নেসা বেগম। শুধু তাই নয় পাশাপাশি তিনি উদার মানসিকতা সম্পন্ন দানশীলা মহিলা ছিলেন।

যদিও তাঁর সঠিক জন্ম সাল জানা যায়না, তবে ঐতিহাসিকদের ধারণা অনুযায়ী সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে ভাগে অর্থাৎ ১৬০০ সালের শেষের দিকে কোন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বংশ মর্যাদার দিক থেকে নাসিরি রাজবংশের কন্যা ছিলেন। তাঁর সবথেকে বড়ো পরিচয়, তিনি হলেন বাংলার রুপকার তথা মুর্শিদাবাদ সঠিক রুপায়ক এবং বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এর দ্বিতীয় সন্তান এবং প্রথম কন্যা। তিনি জিন্নাতুননেশা নামেও ইতিহাসে অধিক পরিচিত। এছাড়াও তিনি দাম্পত্যজীবন সূত্রে বাংলার দ্বিতীয় নবাব সুজাউদ্দিন মহম্মদ খান এর প্রথম সহধর্মিনী।


আজিমুন্নেসা বেগম রাজঘরনার মধ্যে বড়ো হলেও তিনি বিলাসিতার সাথে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেননি। ছোটবেলা থেকেই তিনি শিক্ষানুরাগী ছিলেন এবং নিজেকে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে রেখেছিলেন। তার এমন মানসিকতা তৈরি হওয়ার পিছনে তার বাবার অনেক অবদান ছিল। তিনি যাবতীয় ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলার পাশাপাশি, নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করতেন এবং তিনি প্রচন্ড সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন। তবে তাঁর সবথেকে বড়ো পরিচয় বা মানবিক দিক হল তিনি দান করতেন । ইতিহাসের ভাষ্য অনুযায়ী তার রাজমহলের বাইরে প্রতিনিয়ত শত শত দুস্থ মানুষের আনাগোনা ছিল । পাশাপাশি তিনি ছিলেন উদার মানসিকতার। সব ধর্মকে সম্মান ও মর্যাদার সহিত দেখতেন এবং ইসলামি নিয়মকানুন ব্যক্তিজীবনে কঠোরভাবে পালন করতেন। এছাড়াও রাজকার্যে তাঁর বাবাকে আড়াল থেকে নানা বিষয়ে সহায়তা প্রদান করতেন। এমনকি রাজকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর বাবা মুর্শিদ কুলি খাঁ সমস্যার মুখোমুখি হলে তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন।


আজিমুন্নেসা বেগমকে নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত কথা:


মুর্শিদাবাদের অলিগলিতে বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ স্টেশনে পা রাখার পর থেকেই বিভিন্ন টুরিস্ট গাইডের কাছ থেকে আজিমুন্নেসা বেগম কে নিয়ে প্রচলিত ভুল ইতিহাস শুনতে পায় । এই প্রচলিত ভ্রান্ত ইতিহাসটা নিম্নরূপঃ আজিমুন্নেসা বেগম একজন নিষ্ঠুর, কঠোর হৃদয়ের মহিলা ছিলেন। যদিও প্রথমদিকে এমন ছিলেন না। এক বিরল রোগের কবলে পড়ে তিনি এমন হয়েছিলেন। তিনি নাকি প্রতিদিন একজন করে জ্যান্ত শিশুর কলিজা খেতেন। চিরাচরিত ইতিহাসের সূত্র ধরে জানা যায় তিনি একবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক রাজবৈদ্য তাঁকে বলেন জ্যান্ত শিশুর কলিজা খেলে তিনি নাকি সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাই তিনি রাজকর্মচারীদের ব্যবহার করে শিশুদের কিডন্যাপ করে আনতেন এবং তাদের কলিজা বের করে খেতেন। এরপর তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেও নাকি এই নেশা ছাড়তে পারেননি। তাই প্রতিনিয়ত একজন করে শিশুর কলিজা খেতেন । পরে এটা জানাজানি হলে নাকি তাঁর বাবা ও স্বামী তাঁকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেন। একবার সূক্ষ দৃষ্টিতে ভাবুন এমন ভিত্তিহীন ইতিহাসে বিশ্বাস রেখেছি এখন পর্যন্ত। এই ইতিহাস সম্পূর্ণ বানোয়াট, অবাস্তব এর সাথে বাস্তবের কোন প্রকার মিল নেই। কারণ এর কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি স্বাভাবিকভাবেই মারা গিয়েছিলেন 1734 সালে।
এটা যে মিথ্যা ইতিহাস তার উপযুক্ত প্রমাণ: তাকে যে কলিজাখাকি একজন নিষ্ঠুর মহিলা হিসেবে দেখানো হয়েছে, তা যে সম্পূর্ণ বানোয়াট তা নিচের তথ্যটি প্রমাণ করে।
প্রচলিত ইতিহাস বলে তাঁর ঐ অপকর্মের জন্য তাঁর বাবা ও স্বামী মিলে তাঁকে জ্যান্ত কবর দেন। কিন্তু ইতিহাস দেখলে দেখা যায় তাঁর বাবা মুর্শিদ কুলি খান মারা যান ১৭২৭ সালে। অন্যদিকে আজিমুন্নেসা বেগম মারা যান তাঁর বাবার মৃত্যুর ৭ বছর পরে ১৭৩৪ সালে । তাহলে একজন মৃত বাবা সাত বছর পরে কি করে তাঁর মেয়ে কে জ্যান্ত কবর দেন?? এছাড়াও তাঁর স্বামী সুজাউদ্দিন মহম্মদ খান দীর্ঘদিন আজিমুন্নেসা বেগমের সাথে সেভাবে যোগাযোগ রাখতেন না। তিনি প্রচন্ড বিলাসিতাপ্রিয় ও ভোগ বিলাসে বিশ্বাসী ছিলেন তাই তিনি অন্য স্ত্রীদের সাথে থাকতেন। অন্যদিকে আজিমুন্নেসা বেগম ছিলেন এসবের বিপরীতে। তাই তিনি আলাদাভাবে রাজপ্রাসাদে থাকতেন এবং বিভিন্ন জনহিতকর কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন।
তাহলে আসল সত্য ইতিহাসটা কী; এই প্রতিবেদনের প্রথমাংশে আজিমুন্নেসা বেগমের জীবনী অংশে তাঁর প্রকৃত ইতিহাস উঠে এসেছে। এই অংশ যেটা আছে সেটা হল— আজিমুন্নেসা বেগমের যে কবরস্থান নিয়ে এত ভ্রান্ত ইতিহাস! তাঁর আড়ালে আসল সত্যটা কী?
ইতিহাসের পটভূমি ধরে এগোলে আমরা দেখতে পাবো, আজিমুন্নেসা বেগমের বাবা মুর্শিদ কুলি খাঁ সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সাথে রাজকার্য সম্পর্কিত আলোচনার জন্য মাঝে মধ্যেই দিল্লি যেতেন। সেখানে তিনি দিল্লির জামে মসজিদ পরিদর্শন করেন। যা শাহজাহান নির্মাণ করেন এবং পৃথিবীর সবথেকে বৃহত্তম মসজিদ । জামে মসজিদের গঠন প্রণালী দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। বাংলায় ফিরে এসে তিনি সিদ্ধান্ত নেন জামে মসজিদের আদলে একটি মসজিদ নির্মাণ করবেন মুর্শিদাবাদের বুকে। ফলস্বরূপ তিনি নির্মাণ করেন কাটরা মসজিদ এবং মসজিদের মূল ফটকের নীচে তাঁকে সমাহিত করার নির্দেশ দেন। কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল মসজিদে আগত মুসল্লিদের পায়ের ধুলোয় তাঁর পাপের মোচন হবে। এই একই বিশ্বাস নিয়ে তাঁর বাবার মতোই আজিমুন্নেসা বেগম ১৭৩৪ সালে কাটরা মসজিদের আদলে হাজদুয়ারী প্রাসাদ থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে ভাগরথীর তীরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনিও তাঁর বাবার মতোই নির্দেশ দেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে মূল ফটকের নীচে সমাহিত করতে। কিন্তু অত্যধিক বন্যার কারণে মসজিদটি নদী ভাঙনে নদীগর্ভে তলিয়ে যান। শুধু থেকে যায় আজিমুন্নেসা বেগমের সমাধি। যা এখন ১৯৫৮ সাল থেকে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের আওতায় আছে এবং দর্শনীয় স্থান হিসেবে বহুল পরিচিত। এটা পরিদর্শনের জন্য কোন প্রকার টিকিট মূল্য লাগেনা । শুধুমাত্র দেখভালের জন্য ভ্রমণার্থীদে পিছু ৫ টাকা করে নেওয়া হয়।

পথ-রুট: লালগোলা টু শিয়ালদহ ট্রেন রুটে মুর্শিদাবাদ স্টেশন নামতে হবে। তারপর হাজদুয়ারী অভিমুখে অর্থাৎ আজিমনগরের দিকে যেতে হবে। হাজারদুয়ারী প্রসাদ থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে কাঠগোলা বাগান অভিমুখে রাস্তার ধারে এই সমাধিস্থল পড়বে। মুর্শিদাবাদ স্টেশন থেকে যে-কোনো টো টো ওয়ালা বা ঘোড়ার গাড়ীওয়ালা কে বললেই নিয়ে যাবে সেইখানে। তবে শেষে বলব ঘুরে আসুন ইতিহাসের শহর মুর্শিদাবাদের এই ঐতিহ্যবাহী সমাধিস্থল থেকে।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর