“সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্মগত পাপ ও আজন্ম পাপ পরিত্রাণের চেষ্টা”, লেখক সাদিকুল ইসলাম

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

WhatsApp Image 2021-10-17 at 9.10.30 AM

এনবিটিভি ডেস্ক: আমাদের ভারতীয় বা বাঙালি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে অস্তিত্বহীনতার অনেকগুলো লক্ষণ হয়তো প্রস্ফুটিত, যেগুলো আপনি আমি দৈনন্দিন জীবনে দেখে থাকি। কিন্তূ কিছু ভয়ঙ্কর ঘটমান বর্তমান এবং অদূর অতীতের ঘটনা সমগ্র দেখলে বোঝা যায় যে জনপ্রিয় আখ্যান বা পপুলার ন্যারেটিভের রহস্যময় চক্রবুহ্যের মধ্যে পড়ে কিছু ঘটনার জন্য আপনাকে ঘটনার নিন্দা করতে বাধ্য করা হয়। এই বাধ্যবাধকতার “ফাঁদ” কোনো এক শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে চিন্তা ভাবনা করে তৈরী করা হয়। যেহেতু “জনপ্রিয়, “নিন্দনীয়”, অথবা “সবাই বলছে, আমি কেন পিছিয়ে থাকবো”, অথবা “আমিও বুদ্ধিজীবি” গোছের কোনো এক চিন্তাভাবনার বলয়ে আটকে গিয়ে আপনারা সবাই করে থাকেন।

এই “আপনারা” কারা?

এই আপনারা হচ্ছেন আমি, আপনি, আপনার আশে পাশের কোনো স্টুডেন্ট, কোনো চাকুরীজীবী, কোনও খেটে খাওয়া মানুষ, ডেলি প্যাসেঞ্জার, পরিযায়ী শ্রমিক বা রাজনৈতিক নেতা বা সেই দলের কর্মী।। এঁরা সবাই সেই প্রদীপের তলার অন্ধকারের ছায়াপথ মাড়িয়ে আলোর পথে, উন্নতির যৌবন পথে পদার্পণ করতে চলা এক শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত, পদদলিত সংখ্যালঘু সমাজের অংশ।

এই যে “আপনারা”, হ্যাঁ আপনাদের বলছি : আপনাদের এই যে হঠাৎ করে যেকোনও ঘটনায় মোল্লা নাম যোগ থাকলে সঙ্গে সঙ্গে নিন্দা করতে নেমে পড়েন।। নিন্দা করেন কেন? কারণ আপনাকে এই নিন্দা করতে “বাধ্য” করা হয় বা আপনি Peer Pressure এ নিন্দা করতে বাধ্য হন। সবাই নিন্দা করছে, তাহলে আমারও করা উচিত। এই নিন্দা বা কোনও ঘৃণ্য, অবৈধ, মানবতার বিরুদ্ধে করা যে কোনো সংগঠিত বা অসংগঠিত আক্রমণ, সন্ত্রাসবাদী হামলা বা বানানো কোনো চক্রান্তের ঘটনা, যেটা সন্বন্ধে আপনার পুরো ঘটনার আখ্যান অজানা।

🔹এই “বাধ্যবাধকতা” আসে কোথা থেকে?
🔹কে বা কি আপনাকে বাধ্য করছে?
🔹আপনি কেন একটা বানানো ন্যারেটিভের পক্ষ নেবেন?
🔹আপনারা কোনো ঘটনার নিন্দা করা বা না করার আগে ঘটনার ডিটেল না জেনে কেন কোনও নিন্দার ঝড়ের হাওয়ায় উড়ে যাবেন?

এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন : এই ধরনের ন্যারেটিভ বা এই ধরনের নেতিবাচক সমালোচনার ঝড় কি প্রিভিজলেজড্ কোনও কমিউনিটির উৎসব/বিপদ/কোনও কৃতকার্যের জন্য ওঠে? সোজা কথায় “না”।।

তাহলে সেই একরকম তীব্রতায় এবং তীক্ষ্ণ সমালোচনার ঝড় কেন ওঠেনা? কারণ যাঁরা এই ন্যারেটিভ গুলো তৈরী করেন, তাদের নিজস্ব স্বার্থে আঘাত লাগবে এরকম সামান্য কিছু আঁচ পেলেই, মুষ্টিমেয়র স্বার্থ রক্ষা করার জন্য এবং এইসব নেতিবাচক কর্মকান্ড থেকে নিজেদের জাত, ধর্ম এবং আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ কে রক্ষা করার জন্য সেই দায় অন্য কোনও একটা দুর্বল জাতি বা দুর্বল কোনো আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ সমষ্টির উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এবং পঙ্গপালের মত আমরাও ( “আমরা” কারা তার সংজ্ঞা উপরে দেওয়া আছে) ছুটে গিয়ে নিজেকে বৃহত্তর সমাজের অংশ হিসেবে বোঝাতে গিয়ে তাদের তৈরী ন্যারেটিভ এবং সেই সব তীব্র সমালোচনা, যেটা আপনাদেরকে উদ্দেশ্য করেই তৈরী করা, সেই মেকি তৈরী করা যুদ্ধের যোদ্ধা হয়ে উঠতে চাই, যেটা আসলে ডিফেন্ড বা প্রতিহত করা উচিত ছিল।।

যে কোনো জাতি না জনজাতি কে উদ্দেশ্য করে কোনো একটা ঘটনা বা আখ্যান বা কোনো তথাকথিত “নেতিবাচক” দায় চাপিয়ে দেওয়ার হিড়িক ওঠে, ঠিক তখনই সেই আক্রান্ত বা টার্গেটেড জনজাতির কিছু মানুষের সেই ঝড়কে সমর্থন করার হিড়িক পড়ে।।

এই ঝড় বয়ে যাওয়াকেই রুখতে হবে। একটি তথাকথিত ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনও ঘটনার সম্পূর্ণ তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত কোন ধরনের বক্তব্য, মন্তব্য, সমর্থন বা নিন্দা করা উচিত নয়। নিরপেক্ষ বলে একটা কথা রয়েছে। বোবার যেরকম শত্রু নেই, সেরকম নিরপেক্ষ থাকুন, যতক্ষন পর্যন্ত সম্পূর্ণ বা উল্লেখযোগ্য তথ্যপ্রমাণ হাতে না আসে।

গণতন্ত্রে মেজরিটির রাজতন্ত্র চলে এবং মুষ্টিমেয়র স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র চলে ; সেখানে একটা জনজাতি বা একটা দুর্বল জাতি নিজেদের অবস্থান বেছে নিয়ে সেটার উপরে অনড় থাকবে, এরকম পুঁজি বা সম্পদ তাদের কিছুই নেই। অতএব যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের ন্যারেটিভ তৈরী না করতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তত আপনাকে ছোটো বা আপনাকে অপমান করার উদ্দেশ্যে তৈরি কোনো আখ্যান বা গল্পের অংশ হতে যাবেন না। আপনাদের কে বহিরাগত, উইপোকা, করোনার “সুপার স্প্রেডার”, পাকিস্তানী, বাংলাদেশী, তালিবানি টাইপের যেকোনো আখ্যান একটা সুন্দর শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে প্ল্যান করা হয়। বিশেষ করে সোশ্যাল, প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, রাজনীতিতে, কূটনীতিতে এবং বিদেশনীতিতেও তার প্রতিফলন রয়েছে এবং সেটা চলমান বর্তমান। কারণ? কারণ হলো পুঁজি, সম্পদ এবং ক্ষমতা যারা দখল করে রয়েছে, তারাই তো দেশ, সীমান্ত, সার্বভৌমত্ব এবং দেশের মানুষের মাথার একটা অংশ দখল করে রেখেছে।

ক্ষমতা দখল মানে আর কিছুই না, আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে বিপথে চালিত করে তাদের তৈরী আখ্যানে আপনাকে অটুট বিশ্বাসী তৈরী করে তোলার নামই ক্ষমতা দখলের লড়াই।। এই লড়াই কে শুরু করছে, কে লড়ছে এবং কে এই লড়াইকে ইন্ধন দিচ্ছে, এবং কারা এই লড়াইয়ের টার্গেট বা লক্ষ্য; এইটুকু বিচার করলেই বুঝতে পারবেন যে আপনাকে প্রেশার দিয়ে আপনার স্কুল, কলেজ বা কর্মস্থল কে প্রেশার কুকার তৈরী করে, আপনাকে তাদের তৈরী ন্যারেটিভ কে এগিয়ে নিয়ে যেতে বলছে। ঠিক সেখানেই আপনার নাগরিক অধিকার এবং দায়িত্বের প্রতিফলন হোক। সোজা বলুন, আপনি পুরো তথ্য বা অন্তত সিদ্বান্ত নেওয়ার মত উল্লেখযোগ্য তথ্যপ্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলবেন না বা পক্ষ নেবেন না। পক্ষ নিলে হয় আপনি শত্রুপক্ষ বা মিত্রপক্ষ। আপনি কিন্তু তখন নিরপেক্ষতার বুলি আওড়াতে পারবেন না। আপনাদের কয়েকজনের ভুলের জন্য একটা জনজাতি, উপজাতি বা একটা বড়ো কোনো কমিউনিটির মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার উদাহরণ ঘেঁটে দেখলে বোঝা যাবে, এই ধরনের ঝড়ে অনেকেই উড়ে গেছেন।।

১. তাবলীগী জামাত কে নিয়ে যত ধরনের মিথ্যাচার করা হয়েছে এবং পরবর্তীকালে ICMR এর কিছু বিজ্ঞানী পরে স্বীকার করলেন যে সেই মিথ্যাচারের অংশ তারা হতে চাননি তাই আইসিএমআর ছেড়ে বিদেশে চাকরী করতে চলে গেছেন। তাবলীগী জামাত ভালো না খারাপ নাকি নিরপেক্ষ। তাদের কি অপরাধ ছিল। আইনের আসনসভায় কি তার বিচার হয়েছিলো তাদের কে টিভিতে পেপারে “আতঙ্কবাদী বা সুপার স্প্রেডার” বলার আগে?

২. তালিবানদের আফগানিস্তান দখল নিয়ে সবাইকে মরা কান্নায় ফেটে পড়তে দেখা গেছিলো। সেই মরা কান্না পুরো অস্তমিত জাস্ট একমাস পরেই। ক্রাইসিস কি শেষ? না ক্রাইসিস শেষ হয়নি, ক্রাইসিস টা কে একটা জাতির বিরূদ্ধে কথা বলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা টা শেষ, তাই।। আফগানিস্তান এ কোন সরকার থাকবে বা কোন সরকার থাকবে না, এটা কি ভারতের বা পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভোট দিয়ে ঠিক করেছিলেন নাকি করেন? তাহলে সেখানে কি হচ্ছে, কি কারণে হচ্ছে, ফলাফল কি, তার সামনের সত্য এবং পর্দার অন্তরালে থাকা সত্য এবং অর্ধসত্য গুলো কি কি ছিলো, এসব কি আদৌ আমরা জেনে শুনে বুঝে তারপরে কাউকে খারাপ বা ভালো বলে আখ্যা দিয়েছি? না।।

৩. শাহরুখ খানের সন্তান মাদক কাণ্ডে গ্রেফতার হয়েছে। এই নিয়ে মরা কান্নার শেষ নেই। যেহেতু সে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ তাই তার উপর চাপিয়ে দেওয়া দোষ মানুষের মেনে নিতে সময় লাগে না। কোর্ট এ এখনও পর্যন্ত এক গ্রাম মাদক ওর থেকে উদ্ধার হয়েছে বা ও মাদক সেবন করেছে, এর প্রমাণ নেই NCB র কাছে। কিন্তূ মানুষজন মানে সেই “আপনারা” নিজেদের রূপ দেখিয়ে ঠিক শাহরুখ খান এবং তার পরিবারের জীবনযাপন এবং তার পরিবারের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। ভেবে দেখুন আরিয়ান খান যে কারণে টার্গেট, ঠিক সেই কারণেই আপনাকে বাধ্য করা হয় Peer Pressure দিয়ে যে আপনি যেন ঠিক একইভাবে নিন্দা করেন সেই ঘটনার। পাবলিক প্রেসার তৈরি হবে, তার ইমেজ ধাক্কা খাবে। ফাইনালি “মুসলিম রা ওরকম ই হয়” টাইপের একটা পাবলিক সেন্টিমেন্ট তৈরি হবে। ঠিক যেটা তাবলীগী জামাত এর ক্ষেত্রে হয়েছিলো।

একজন সচেতন নাগরিক হওয়ার প্রধান দায়িত্ব হলো আপনি কারোর জেনে বুঝে ক্ষতি করবেন না। যদি জেনে গেছেন যে আপনার কোনো কর্ম একটি জনজাতির বা একটি বৃহত্তর জাতির ক্ষতি করছে, তাহলে সেই কাজ থেকে দূরে থাকবেন।

এই লেখার মূল সারবত্তা এবং সারমর্ম হলো “আপনারা” যেহেতু পুঁজিহীন এবং সম্পদহীন (অন্তত দেশব্যাপী সোশ্যাল, প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে কন্ট্রোল করার মতো পুঁজি বা সম্পদ যেহেতু নেই), সেহেতু আপনারা সেই পুঁজি এবং সম্পদের উপর ভর করে আপনাদের কে যে তথ্য (যে তথ্যের সত্যতা যাচাই না করেই বা ইচ্ছে করে সত্যকে লুকিয়ে কিংবা মিথ্যে তথ্যকে সত্যের মত প্রচার করা হয় থাকে) “স্পুন ফিড” বা চামচে করে গুলিয়ে খাওয়ানো হয়, আপনি সেটাই খান। সেটাই হজম করেন এবং পরে সেটার ভিত্তিতে জাবর কাটেন।।

অতএব যারা আপনার এবং আপনার জাতির উপর শোষণ এবং উৎপীড়নের অস্ত্র হিসেবে কোনো তথ্যসমৃদ্ধ ন্যারেটিভ তৈরী করা হবে এবং আপনি সেই ন্যারেটিভের অংশ হয়ে উঠবেন, সেটা কাম্য নয়। আপনার নাগরিক হওয়ার প্রথম শর্তটা পালন করুন। তথ্য এবং জ্ঞান আহরণ এর সময় খেয়াল রাখবেন যে কোনো জ্ঞান বা তথ্য “পরম” বা অ্যাবসলিউট নয়।

তথ্য যাচাই করুন, যাচাই করার সাধ্য বা উপায় না থাকলে ধৈর্য ধরুন। সঠিক তথ্য দিয়ে নিজেকে সাহায্য করুন। তথ্যের বিকল্প সোর্স বের করুন। আপনি যদি একটাই নিউজপেপার পড়েন তাহলে অন্য কোনো একটা নিউজপেপার পড়ে দেখুন। যদি একটা নিউজ চ্যানেল আপনার পছন্দ তাহলে সেটা থেকে দূরে গিয়ে অন্য একটা চ্যানেল দেখুন। যদি একটা দেশের ই মিডিয়ার খবর পড়ছেন, যেটাকে কম বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়, তাহলে তুলনামুলক কোনো বাইরের দেশের মিডিয়ার খবর পড়ুন। খবর বা তথ্য আপনাকে কোন দিকনির্দেশ করছে সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। আরো আরো বেশি একটা ইস্যু নিয়ে পড়াশোনা করুন। তথ্য যোগাড় করুন। তারপরে নিজের কোনো মতামত বা বক্তব্য রাখুন।। তাহলে অন্তত আপনার থেকে কোনো ভুল তথ্য ছড়াবে না। আপনি একাই একজন হলেও সঠিক তথ্য টা জেনে রাখুন। ধরে রাখুন। পৃথিবীতে যদি কোনো একদিন শুধু মাত্র তিনজন মানুষ বেঁচে থাকেন এবং তাদের মধ্যে আপনি একজন হন, তাহলে অন্তত বাকি দুজন যদি ভুল টাও জেনে বিশ্বাস করে থাকেন, অন্তত আপনার থেকে তাঁরা সত্যিটা জেনে অন্তত এইটুকু বুঝতে পারবেন যে “সত্যেরও” ডাইমেনশন বলে কিছু একটা আছে।। সেখান থেকেই শুরু হবে সত্যের খোঁজ। সেটা যতটাই দীর্ঘ হোক না কেনো।।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর