লেখক, প্রাবন্ধিক হাবিব আহসান আর নেই!

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

image

~হাফিজুর রহমান, আসোসিয়েট এডিটর, এনবিটিভি

বালিগঞ্জ পার্ক রোডে টিএমসির প্রাক্তন মন্ত্রী, এখন বিধায়ক হুমায়ুন কবির সাহেবের ছেলের বিয়ের রিসেপশনে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ফোনে দুঃসংবাদ পেলাম ‘হাবিব আর নেই’।  গিফট প্যাকেট ফেলে মাথা ধরে বসে পড়লাম। এ অবস্থায় কীভাবে নিমন্ত্রণে যাবো! হাবিব, হাবিব আহসান এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ৮০র দশকে। তখনও আজিজ সাহেব সম্পাদিত ‘গতি’ প্রকাশিত হয়নি। ‘কাফেলা’ নতুন ভাবে নতুন সাজে আত্মপ্রকাশ করেছে। হাবিব মুর্শিদাবাদ থেকে এসে উঠলো গোলতালাও  সংলগ্ন মডার্ন টাইপ সেন্টারের চিলেকোঠায়। এখনকার ‘নতুন গতি’র সম্পাদক ইমদাদ তখন ছিপছিপে এখনকার মত গায়ে-গতরে নয়। অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে কলকাতার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত বুনো ঘোড়ার  মত দৌড়ে বেড়াতো। ও থাকতো অ্যাডভোকেট তাজাম্মুল হুসেনের মডার্ন টাইপ সেন্টারের চিলেকোঠায়। আমি তখন সবে লেখালেখি শুরু করেছি।

‘আজকাল’ দৈনিকের পাশাপাশি ‘ইন্ডিয়া টুডে’তে আমার লেখা বেরিয়েছে। ‘কাফেলা’য় লেখা শুরু করেছি। ‘কাফেলা’য় মাসান্তিক সাহিত্যসভায় ইমদাদ এর সঙ্গে আলাপ। থাকতাম আলিমুদ্দিন লাগোয়া শরীফ লেনে। বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ার ওখানেই হাবিব আহসানের সঙ্গে প্রথম আলাপ। আমার থেকে বয়সে বড় হলেও জমে যেতে সময় লাগেনি। হাবিব আমার মত স্ট্রীট-স্মার্ট না হলেও শিক্ষাদীক্ষা লেখা সব মিলিয়ে অনেক উপরে। হাবিব বাংলা আর

সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর আর আমার সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ভালো।

আমার লেখা শুকনো কাঠ হলেও হাবিব নীরস তরুবর। হাবিব তখন আরো রোগা। ওকে পার্ক স্ট্রীটে চাইনিজ খাওয়াতে নিয়ে গেছিলাম। তুমুল আপত্তি করেছিল। ওর ধারণা ছিল চিনেরা আরশোলা খায়, বহু কষ্ট করে ওকে খাইয়েছিলাম। পরে হাবিব মিত্র প্রকাশনের পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্টের অফিসে জয়েন করে। প্রথম স্যালারি পেয়ে আমাকে বার বি কিউ রেস্তোরায় চাইনীজ ট্রিট দিয়েছিল। ‘কাফেলা’ থেকে এমদাদের ঠেক ছেড়ে হাবিব রিপন স্ট্রীট সংলগ্ন বিরুস লজে উঠলো। দিনে 30টাকা বেড ভাড়া।  আমার বাড়ি থেকে হাবিবের লজের দূরত্ব কম, কাজেই মোলাকাত হতো ঘন ঘন। বলতে গেলে রোজই দেখা হতো। দুজনে বসতাম রিপন স্ট্রিটের এঙ্গোরা হোটেলে। কেরালিয়ান হোটেল। লোকে বলতো চুলিয়া হোটেল। এঙ্গরার কেরলিয়ান ম্যানেজার কাদির আমাকে প্রশয় দিত।

আমার জন্য কোণের একটা কালো গোলটেবিল ছিল ওখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারলেও কিছু বলত না। দু টাকার বিফ চাপ আর 50 পয়সার করে তন্দুরি রুটি ছিল। হাবিব আমার মত সবজি ভালোবাসত। রেস্টুরেন্টের খাবার সহ্য হত না ওর।  মাঝে মাঝে বাড়িতে খাওয়াতাম। মা দেশে গেলে হাবিব আমার বাড়িতে এসে থাকতো।  ইমদাদ তখন আজিজ সাহেবের কাছ থেকে ‘গতি’ পেয়েছে গোটা বাংলা চষে ফেলছে  বিজ্ঞাপন আদায় করতে। ‘গতি’র দায়িত্বে ছিল গড়িয়ার ছেলে মামুন। মানেজার আনোয়ার হুসেন, বিড়ি আর চা পেলেই খুশি। স্যান্ডেল স্ট্রীটে ‘গতি’ অফিসে তুমুল আড্ডা। আর খিদে পেলে এঙ্গোরার গোলটেবিল। ওসমান ভাই আমাদের দেখলেই সাদরে বসাত। এঙ্গোরার আড্ডা থেকে বেরিয়েছিল আমার সম্পাদিত ‘এ বাংলার মুখ’। যা নিয়ে আনন্দবাজারে কলকাতার কড়চায় বেরিয়েছিল। হাবিব বেশিদিন মিত্র পাবলিকেশনে টিকতে পারেনি। মালিকের অবর্তমানে সম্পাদক পুকুর চুরি করত। হাবিবের লেখার সঙ্গে আমার ছবি ছাপা হতো। ছবির পয়সা মার যেতো।

একবার সহ্য না করতে পেরে সপাটে থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়েছিলাম চোর সম্পাদককে। পরে পার্ক স্ট্রীট থানায়। ওসি মিটিয়ে দেওয়ার নাম করে ঘুষ চাইছিল। আমার গুরু আইন রশিদ খান তখন ডিসিডিডি। ফোনে সব জানিয়েছিলাম। ওসি  আমার কাছে মাফ চেয়েছিল আর মিথ্যা বলার জন্য সেই চোর সম্পাদক কান ধরে উঠ বোস করিয়েছিল। হাবিব তখন আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। পুকুর চুরিতে অংশ না নেওয়ায় চাপ বাড়ছিল হাবিবের উপর। সম্মান বাঁচাতে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয় সে।

আসলে হাবিবের লেখা পত্রিকা গোষ্ঠীর মালিকদের চোখে পড়েছিল। তাই  কায়দা করে ওর পেছনে লেগে বাধ্য করা হয়েছিলো ওকে চাকরি ছাড়তে। আসলে হাবিব লেখার বাইরে কিছু বুঝতনা।ওর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিল সবাই। মোটা মোটা বই অনুবাদ করেছে নাম মাত্র টাকায়। এ ব্যাপারে কওম দরদি কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশক আর মিত্র প্রকাশনের পত্রিকা সম্পাদক সব সমান আর যে দুটি দৈনিকে কাজ করেছিল তারাও ওর সঠিক মুল্যায়ন করেনি। টাকা পয়সা দেয়নি ঠিকমত। সংসার চালাতে লেখা ছেড়ে  বইয়ের ব্যবসায় নামতে  হয়েছিল। সেটি ওর মন ভেঙে দিয়েছিল, লেখায় প্রতিক্রিয়া পড়েছিলো। আমার কাছে ছিল কয়েকদিন, চোখের অপারেশন এর সময়। অনেক কথা বলেছিল যা বলা যাবেনা।  বার বার বোলপুরে ছুটে গেছি কাজের খবর নিয়ে বিফল হয়ে ফিরে এসেছি। হাবিবের হাত চলছিলো না। মাস দুয়েক আগে হাবিবের সঙ্গে শেষ দেখা। দেখে কষ্ট হয়েছিলো পারকিনসন আক্রান্ত হাবিবের দুনিয়া বিছানায় সীমাবদ্ধ। চলতে ফিরতে পারছে না। ওর স্ত্রী পাপিয়া ওকে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছে দেখে চোখ ভিজে গিয়েছিল। চলে যাওয়ার দুদিন আগে কথা বললো। বাঁচতে চেয়েছিল, লিখতে চেয়েছিলো। অসহায় হয়ে দেখেছি। কী সমাজে বাস করছি আমরা যেখানে হাবিবের মত প্রতিভা অকালে ঝরে যায়, আর বেঁচে থাকতে আমরা পাশে দাড়ায়না আর চলে গেলে কাসিদা পড়ি। 

আলবিদা দোস্ত! যেখানে থেকো ভালো থেকো চিন্তা করোনা আমি আসছি। তোমার মত আমিও পারকিনসন গ্রস্ত, শুধু সময়ের অপেক্ষা।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর