দুর্নীতি মুক্ত দেশ কীভাবে সম্ভব?

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

depositphotos_71472147-stock-illustration-businessman-hand-refusing-the-offered

~মোঃ নিয়াজ

দুর্নীতির বিষাক্ত ছোবল বা অভিশাপ থেকে কোনও দেশই মুক্ত নয়। সরকার যদি জনকল্যাণকামী হয়, রাষ্ট্র যদি প্রকৃত অর্থে কল্যাণকর হয়, তাহলে সেই দেশে দুর্নীতি বলে কিছু থাকতে পারে না। অঙ্কুরেই দুর্নীতির বিনাশ করত সেই দেশপ্রেমী সরকার। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই দুর্নীতির মূলোৎপাটন এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের ময়দান কাঁপে। কিন্তু মসনদে বসে সেই সরকারের কাজকর্মে দেখা যায় উলোট পুরাণ।

ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজরা সাফাই দিয়ে বলে থাকে, এটা সেবা বা পরিষেবার বিনিময়ে পাওয়া উপহার। কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে মানুষ তাকে অর্থ, উপঢৌকন দেয় বা অন্যরকম কিছু সুবিধা প্রদান করে থাকে, বকলমে এগুলো সবই আসলে ঘুষ। যা দুর্নীতির নামান্তর বললে নেহাত অত্যুক্তি হবে না। মনে রাখতে হবে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার কাজের জন্য রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থেকে বেতন পায়। তাই কাজের বিনিময়ে আর্থিক আনুকূল্য বা উপঢৌকন নেওয়া অন্যায়।

অধিকাংশ পেশার ক্ষেত্রেই এসব কর্মকাণ্ড দেখা যায়। টেবিলের নীচ দিয়ে দেদার চলে এর লেনদেন। বিশেষ করে সরকারি অফিস কাছারি তো ঘুষ ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রতি পদে সেখানে ঘুষ দিতে হয়।

আসল কথা হল, জবাবদিহীর চেতনার অভাবেই দুর্নীতির এহেন রমরমা। দুর্নীতি একটি নেতিবাচক শব্দ। নীতিবহির্ভূত সব কাজকেই দুর্নীতি বলা যায়। আভিধানিক পরিভাষায় দুর্নীতি বলতে ঘুষ, অর্থ আত্মসাৎ, বলপ্রয়োগ, প্রভাব খাটিয়ে ভীতি প্রদর্শন, স্বজনপোষণ ও ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্পিত দায়িত্ব পালনে অনীহা বা গাফিলতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদিকে সবকিছুকেই বোঝায়।

সুন্দর ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে বা সুসংহত পরিবার ও সুস্থ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে শুধু নেতামন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি বা সরকারি অফিসারই নয়, সমাজের সব স্তরের মানুষকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। সকলকে মানবিক ও সংবেদনশীল হতে হবে। প্রশাসনের মানবিক মুখ থাকতে হবে।

দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি যে-ই হন না কেন, যতই প্রভাবশালী হন না কেন, তাকে কাঠগড়ায় তুলতে হবে এবং দূষ্টান্তমূলক শাস্তি সুনিশ্চিত করতে হবে। সরকার, প্রশাসন, আইন ও বিচারবিভাগকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হবে। কেবলমাত্র আইন ও বিধান দিয়ে দুর্নীতি দমন বা নির্মূল সম্ভব নয়। দুর্নীতির হাত অনেক লম্বা। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এর অবাধ যাতায়াত। ক্ষমতার অলিন্দে ঘু ঘু পাখির মতো বাসা বেঁধে রয়েছে দুর্নীতি।

এমনিতেই আইন আদালত হল একটি দী…র্ঘ প্রক্রিয়া। প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় ১৮ মাসে বছর হয়। আর দীর্ঘসূত্রিতা হল রাষ্ট্রীয় পরিচালন ও পরিকাঠামোর সহজাত প্রবৃত্তি।

মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগেই রাজস্থানের জয়পুরে এক অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কীরেণ রিজিজু ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন.ভি রমন্না। সেই মঞ্চ থেকেই দুজন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাখেন। যা থেকে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্ট সহ দেশের সমস্ত আদালতে ৬ কোটিরও বেশি মামলা অমীমাংসিত বা ঝুলে রয়েছে।

আবার আইনে থাকে বিভিন্ন ধরনের ফাঁক-ফোকর। দুর্নীতি প্রতিরোধে আইন ও শাস্তির বিধানের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। যা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ। দুর্নীতি ও দর্বৃত্তায়নকে সমাজ তথা দেশ থেকে চিরতরে বিদায় করতে হলে সবার মধ্যে মানবতা, নৈতিকতা, মুনুষ্যত্বের বীজ বপন করতে হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ভারসাম্যপূর্ণ মানবিকতা বাস্তবায়ন করতে পারলে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করা সম্ভব।

অপরাধী, দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানে স্বচ্ছ আইন এবং তা দ্রুত কার্যকর করতে হবে। কোনো অপরাধী, দুর্নীতিবাজের শাস্তি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা করার অপশন রাখা চলবে না। অসৎপন্থা, অশুভ ব্যবসা, কালোবাজারি, মজুতদারী করে উপার্জনের প্রবণতা থেকেই মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। তাই এ ধরনের অবৈধ উপার্জনের পথ পরিহার করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।

দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে সবার আগে সমাজ থেকে ঘুষ নিষিদ্ধ করতে হবে। এই অভিশপ্ত লেনদেনকে এখন ডোনেশন নাম দেওয়া হয়েছে এবং আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন বৈধ কাজকে বৈধ করতেও ঘুষ দিতে হয়। এটাকে আমরা গরহিত বলে মনে করি না। আমাদের মানসিকতা এমনই হয়ে গেছে। দুর্নীতির ভাইরাস এতবেশি ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো অযোগ্য ও অসৎ ব্যক্তিদের অসদুপায়ে নিয়োগ ও পদোন্নতি। মনে রাখতে হবে কর্মকর্তাদের কাছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ ও মানবসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আবশ্যক। কিন্তু তাই কি হচ্ছে?

আমজনতাকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতি দমনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখা যায়। জনগণ সচেতন হলে দুর্নীতি দমন অভিযান সংক্রান্ত কর্মকর্তাদের টনক নড়ে, ফলে তারা একটু নড়েচড়ে বসে।
বলাবাহুল্য, পৃথিবীতে মানুষ যত দিন থাকবে দুর্নীতিও থাকবে। মনুষ্য রচিত আইনে সমাজ বা রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভবপর নয়।

তবে প্রশাসন বা সরকারের সদিচ্ছা থাকলে, তারা সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করলে দুর্নীতির মাত্রা লাগামছাড়া হতে পারবে না। এক্ষেত্রে বেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে সদিচ্ছা আমাদের অধিকাংশেরই নেই। তাই জগদ্দল পাথরের আকার নিয়েছে দুর্নীতি।

দুর্নীতিকে আমরা কেউই সমর্থন করি না, বরদাস্ত করি না। কিন্তু সুযোগ পেলে সেই আমরাই দুর্নীতি করতে পিছপা হই না। এটা আমাদের মানবীয় দুর্বলতা, এটা আমাদের সহজাত দ্বিচারিতা। সিংহভাগ মানুষই এই সামাজিক ব্যাধি ও অভিশাপ থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু আমাদের সামনে এর সমাধানের রাস্তা স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ প্রথাগত ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া আমাদের সামনে বিকল্প কিছু নেই। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো ব্রিটিশের মতো ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসিতে চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা নিত্যদিন সেই যূপকাষ্ঠে বলি হচ্ছি।

একটি দেশের আর্থিক উন্নতির অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। অথচ আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হলে সর্বপ্রথম নিজেকে দুর্নীতি-মুক্ত করতে হবে। কারণ আমরা সামাজিক জীব। আমরা কেউ সমাজ বহির্ভূত বা অসামাজিক জীব নই। আর সমাজ গড়ে ওঠে ব্যক্তিকে নিয়েই। তাই সমাজ সংস্কারের প্রাথমিক দায়িত্ব আমাদেরই ওপর বর্তায়। আমাকে দিয়েই শুরু হয় রাষ্ট্র ও সরকার।

মার্কসবাদ, গান্ধীবাদ, পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ সব মতবাদকে এরা রাজনীতির অভিধান থেকে চিরতরে বাদ দিয়ে দিয়েছে। সব তাত্বিক মতবাদকে এরা বরবাদ করে দিয়েছে। সব মতবাদকে এরা ভোগে পাঠিয়ে দিয়ে যে নির্যাসটা বের করেছে, সেটা হল ভোগবাদ। দেশের রাজনীতিতে ভোগীরাই এখন যোগী সেজে বসে আছে।

আসল কথা হল, ভোগবাদ ও বস্তুবাদের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি মানুষকে প্রাচুর্য্য ও ঐশ্বর্য্যের জন্য মরিয়া করে তোলে। ফলে মানুষ অবৈধ রোজগারের দিকে ধাবিত হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। গাড়ি, বাড়ি, নারী ইত্যাদির পিছনে হন্যে হয়ে ছুটতে থাকে। ভোগবিলাসের সব মাত্রা ও সীমা ছাড়িয়ে যায়। কী করছি, আর কী করা উচিত – এসব নিয়ে কেউ বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। দুচোখের কার্ণিশে বাসা বাঁধে শুধুই রঙিন স্বপ্ন। সাব-কনসাস মাইন্ড বা অবচেতন মন তাকে বলতে থাকে আরও চাই, আরও চাই।

তখন সে নিজেকে লম্বা রেসের ঘোড়া মনে করে। ডান, বাম, সামনে, পিছন কোনওদিকেই তাকায় না। লক্ষ্য ও কক্ষে অবিচল থাকে। অর্থ ছাড়া তার চোখের পলক পড়ে না। ধ্যান, জ্ঞান সবকিছুই অর্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কিন্তু সেই টাকা কোথা থেকে আসছে, কেন আসছে, না এলে কী হবে, এই অর্থ তাকে ওভারঅল কী দেবে, তার শেষ পরিণতি কী, তার গন্তব্য কোথায় – কোনওকিছুই ভাবার অবকাশ তার নেই। টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে বিবেকের অপমৃত্যু ঘটে।

রাজনীতির জটিল ও পঙ্কিল আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে আমাদের মানবতা, মনুষ্যত্ব, বিবেক, মূল্যবোধ সবকিছু ক্ষয়িষ্ণু ও বিনষ্ট হতে থাকে। নৈতিকতার চরম অবক্ষয় ও মনুষ্যত্বের মহা সংকট আমাদেরকে গ্রাস করে ফেলেছে।

দুর্নীতির একটা অন্যতম কারণ হল অধীনস্ত কর্মচারীদের সীমিত বেতন-ভাতা বা বৈষম্য। অতিরিক্ত কাজের বোঝা কর্মচারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এবং ন্যায্য পারিশ্রমিক বা বেতন থেকে বঞ্চিত করা। এজন্য অনেকেই রোজগার বাড়াতে অসৎ পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়।

দুর্নীতি রমরমার আরেকটি অন্যতম কারণ হল, বিচার ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতার অভাব। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিচারকে ব্যবস্থাকে কলুষিত বা প্রহসনে পরিণত করা হয়। দুর্নীতি প্রতিরোধের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো বিচার ব্যবস্থার পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা। বিচার বিভাগকে প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ রাখতে পারলে দুর্নীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বৈ কী।

রাজনীতির ছাতার তলায় আশ্রয় নেওয়া বা প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে সাত খুন মাফ, আর সাধারণ মানুষের লঘু পাপে গুরু দণ্ড কাম্য নয়। আইনের চোখে সবাই সমান। রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরকেও জবাবদিহীর আওতায় আনতে হবে। জেতার পর তারা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কতখানি রক্ষা করেছেন, তার জওয়াব দিতে হবে। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা কোথায় কী কাজ করেছেন, সেইসব কাজের ইউসি, উপভোক্তাদের তালিকা ইত্যাদি বিস্তারিত বিবরণ সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং জনতার আদালতে পেশ করতে হবে। তবেই তিনি পুনরায় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা করতে পারবেন।

আর যদি তাদের কর্মকাণ্ডে গরহিত অপরাধ প্রমাণ হয়, তাহলে তার সুষ্ঠু বিচার হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক সাজা হবে। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি পুনরায় কোনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। এক ব্যক্তি একাধিক জায়গা বা কেন্দ্র থেকে লড়তে পারবেন না। দলবদল করা চলবে না। যে দলের টিকিটে জয়ী হয়েছেন, সেই দলেই বিধায়ক বা সাংসদ হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর