সৌমিত্র দস্তিদারের সাথে একদিন

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

WhatsApp Image 2021-11-20 at 3.52.14 PM

আসিফ আক্রাম 

মুম্বই এসেছিলেন সৌমিত্র দস্তিদার। এসেই ফোন করলেন আমায়। বললেন আসিফ আমার দিন ভালো যাচ্ছে না, তোমার সাথে যে দেখা নেই। দেখা করার দিনক্ষণ হলো বাইশে অক্টোবর। শুক্রবার। পরের দিনই রওনা হবেন কলকাতায়। মেয়ের ফ্ল্যাটে আপাতত আশ্রয় নিয়েছেন। মেয়ে এবং জামাইবাবু দুজনেই অ্যাড এজেন্সিতে কাজ করেন। মেয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা করেছে জেনে একটা কানেকশন তৈরী হয়ে গেল (যেহেতু আমিও প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী)। সৌমিত্র দার সাথে আমার আলাপ এই বছরের গোড়ায়, ভোটের আগে। উনি তখন আইএসএফ পার্টির মধ্যে ভাসানীর ছায়া দেখতে পাচ্ছিলেন কিন্তু সময়ের সাথে বুঝেছেন বাস্তবটা ভিন্ন। আব্বাস সিদ্দিকী আর যাই হন না কেন ভাসানী কখনও নন। সে যাই হোক, উনার সাথে আলাপ হয়েছিল আমার ভাসানী চর্চার সূত্রেই। বেশ কিছু বছর ধরেই ভাসানীর জীবন নিয়ে একটা উৎসাহ তৈরী হয়েছে, বিশেষ করে উনার পালনবাদ বা উর্দুতে রবুবিয়ৎ নিয়ে আমার যথেষ্ট উৎসাহ তৈরী হয়। বাংলাদেশের ফরহাদ মজহারের লেখা নিয়েও আমি অবগত হয়েছি। সে যাই হোক, সৌমিত্র দার আমি আর আমার মওলানা ভাসানী দারুণ সাড়া ফেলে বাঙালি মুসলিমদের শিক্ষিতদের মধ্যে। সেই সূত্রের তাঁর নম্বর যোগাড় করে মওলানা ভাসানী নিয়ে একদিন তাঁর সাথে কথা হয়। তাই যখন জানতে পারলাম উনি মুম্বাইয়ে আসবেন, চিত্তে উদয় হলো এক দীর্ঘ আলোচনার আশা। কাজের সুত্রে আমি পাওয়ায়ে থাকি। আইআইটি বম্বেতে পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করি। বাঙালি মুসলিম সমাজের ইতিহাস নিয়ে সম্প্রতি একটা উৎসাহ তৈরী হয়েছে।

সৌমিত্র দার কাজ নিয়ে আশা করি সকলেই কমবেশি অবগত আছেন। উনি ভাসানী নিয়ে যেমন গবেষণা করেছেন, বাঙালি মুসলিম সমাজের আর্থ সামাজিক অবস্থা নিয়ে তথ্যচিত্রও বানিয়েছেন। কাশ্মীর নিয়েও কাজ করছেন। ভাসানী নিয়ে এখন একটা তথ্যচিত্রও বানাচ্ছেন।

তা মূল কথায় ফিরে আসি। বাইশে অক্টোবর দেখা করার দিনক্ষণ ঠিক হলো। মোটামুটি ঠিক হলো যে আম্বেদকরের সমাধিস্থল, হাজী আলী এবং জিন্নার বাড়ি ঘুরবো। তাঁর সাথে যাবো পুরনো একটা সিপিআইএর একটা অফিস। সকালে পৌঁছে গেলাম সৌমিত্র দার মেয়ের বাড়িতে। সেখান থেকে সোজা রওনা হলাম আম্বেদকরের সমাধিস্থল। আম্বেদকরের সমাধিস্থলের নাম চৈত্যভূমি। এটা একটা বৌদ্ধ চৈত্য। দাদর পশ্চিমে সমুদ্রের তীরে এক মনোরম পরিবেশ ঘিরে থাকে এই পবিত্র ভূমিকে। ছবি তোলার অনুমতি নেই তাই বাইরে থেকেই ছবি নিতে হলো। ভেতরে এক মনোরম পরিবেশে চলছে আম্বেদকরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। অদ্ভুতভাবে মূল কেন্দ্রে রয়েছে শুধু বৌদ্ধ মহিলারা আর পুরুষরা মূল কেন্দ্রের বাইরে দূরে বসে। সুরেলা কণ্ঠে স্তুতির পর পুজন সমাপ্ত হল। আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। বেশ তেষ্টা পেয়েছিল, তাই আখের সরবৎ আর জল পান করে যেন প্রাণ ফিরে এল। আমাদের মধ্যে কিন্তু এর মধ্যেই দারুণ আলোচনা শুরু হয়েছে। বর্ণহিন্দু সমাজের যে তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ তার উৎস কি? এই নিয়ে একটা বৌদ্ধিক আলোচনা চললো। এই রোগ যে শিক্ষিত মহলে আরো বেশি সৌমিত্র দা সেটা বারবার বোঝাতে চাইলেন।

আলোচনার ফাঁকেই সিদ্ধান্ত হলো যে এবার হাজী আলী যাওয়া যাক। হাজী আলীকে গিয়ে যেন একটা শান্তি অনুভব করলাম। এক অদ্ভুত প্রশান্তি আর ঠান্ডা শীতল আবহাওয়া যেন আমায় ঘিরে বসলো। ভেতরে উনি গেলেন না, আমি মসজিদের ভেতরে গিয়ে অজু করে বেরিয়ে এলাম। এখনও জুম্মার সময় হয়নি। গোষ ভাত দেখে লোভ সামলাতে না পেরে চত্বরের দোকান থেকে এক প্লেট গোশ ভাত গোগ্রাসে খেয়ে ফেললাম। পেটে একটু খাবার পড়ল। এরপর পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে সরবৎ বানিয়ে খেলাম। রেস্টুরেন্টের মালিক আবার মুর্শিদাবাদের ছেলে। রেস্টুরেন্টে বসে অনেক গল্প হলো। আমরা এই সিদ্ধান্তে এলাম যে মুসলিম সমাজকে কান্নাকাটি নয়, বরং একটা সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কাঠামো তৈরী করার চেষ্টা করা উচিত। খেতে খেতেই সিদ্ধান্ত হলো এবারে জিন্নার বাড়িটা দেখে আসি। ট্যাক্সিতে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর বাকিটা হেঁটে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। দুর্ভাগ্যবশত: সেদিন কোন পীরের বোধয় কোন বক্তৃতা ছিল, অনেক অনুগামীর ভিড় দেখলাম। জিন্নার বাড়ির সামনে এসে ইচ্ছে হলো একটা ছবি নেওয়ার। এ মা! একটা লোক হঠাৎ দেখি উঁচু গলায় বলে উঠলেন ছবি নেওয়া যাবে না (বাইরে থেকেও)। জিজ্ঞেস করলাম আপনি কে বলছেন? ক্ষিপ্ত হয়ে সেই ব্যক্তি আমাকে শিক্ষা দিতে চাইলেন। বললেন কোথা থেকে এসেছিস রে ছোঁরা? তোর সাহস তো কম নাই? নাম কি? কোথায় থাকিস? সব বল বেটা। তোকে দেখাচ্ছি মজা। জিন্না নিয়ে এত উৎসাহ? জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তিরা যে শত্রুপক্ষকেও গভীরভাবে অনুধাবন করতে চান কে বোঝাবে এই মূর্খকে। যাইহোক, কথা না বাড়িয়ে আমরা কেটে পড়লাম। গেলাম একটা দক্ষিণ ভারতীয় রেস্টুরেন্টে। কিন্তু গিয়ে দেখি তিনটের আগেই বন্ধ। অগত্যা সিঙ্গারা খেয়েই রওনা দিলাম পুরনো সিপিআই অফিসে।

সৌমিত্র দা ১৯৪৬ সালের নৌবিদ্রহ নিয়ে বেশ উৎসাহী। এই নিয়ে একটা তথ্যচিত্রও বানাতে চান। এই উপলক্ষেই রবীন্দ্র নাট্যমন্দিরের কাছেই একটা পুরনো সিপিআই অফিসে গেলাম। দেখা করলাম তার হত্তাকর্তাদের সাথে। কিন্তু কোন তথ্য পাওয়া গেল না। পাশেই একটা দক্ষিণ ভারতীয় রেস্টুরেন্টে ধোসা আর পিজা খেয়ে রওনা দিলাম সৌমিত্র দার মেয়ের বাড়িতে।

সৌমিত্র দার মেয়ে জামাই সব আমার বয়সী। বেশ আড্ডা হলো। পরে দেখা করবো বলে কথাও হলো। কিন্তু পরের দিন ফ্লাইট বলে আমাকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হলো। অটো আর ট্রেন ধরে ঘরে ফিরলাম। সৌমিত্র দা আবার ফোন করে খোঁজ নিলেন আমি ঠিকঠাক পৌঁছেছি কিনা। খুব সজ্জন ব্যক্তি উনি। পরের দিন আবার উনার সাথে বিস্তারিত কথা হলো। তবে উনার সাথে দেখা করে একটা ব্যাপার বুঝলাম। উনি খুবই মানুষ দরদী একটা সত্যিকারের ভালো মানুষ। এই মানুষটার মনে কোন খাদ নেই। তবে বাংলায় এই ধরনের মানুষ ক্রমশই বিরল। জাতি ধর্মের ওপর উর্ধ্বে উঠে কতজন পারে অন্যজাতির নেতাকে আপন করে নিতে?

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর